Image: of 55     Loading Rotate Image
 
Keyboard controls
 
Help     Bold Text
 
Resize Text
 
  Toolbar

Manuscript & Transcription: RBVBMS_134(i)


Bichitra: Online Tagore Variorum :: School of Cultural Texts and Records

tagore_manuscript
 

**১

*বিসর্জন
*Stage direction of the Performence in 1330 BS.

ঝুনু
জননী তোমার অরুণচরণখানি
প্রণাম ও প্রস্থান—
শঙ্খ ঘণ্টা ইত্যাদি
রাজার প্রবেশ—

**২

গোবিন্দমাণিক্য
অপর্ণার প্রবেশ
{assending steps.
rushes in}
অপর্ণা । বিচার প্রার্থনা করি!
রাজা । কিসের বিচার!
{<+++> {throws} herself down}
অ. । দুইদিন দ্বারে তব কাঁদিয়া ফিরেছি
প্রহরী তাড়ায়ে দেছে।
রাজা । কে তুমি, কি চাও, বৎসে
জানাও নির্ভয়ে।
{gets up}
অ. । আমি ভিখারীর মেয়ে—
পিতা মোর অন্ধ বৃদ্ধ— গান গেয়ে ভিক্ষা
মেগে ফিরি!
রাজা । আহা তোমারে কে দিল ব্যথা?
অ. । যতনে পালিয়েছিনু আপনার কোলে
মাতৃহীন ছাগশিশু। দুধের মতন
শাদা— কেবল কপালে ছিল কাল রেখা।
তারে কেন কেড়ে নিলে?
রাজা । এমন নির্দ্দয় কে সে?
জান কে নিয়েছে তারে?
অ. । রাজ ভৃত্য তব।
রাজমন্দিরে পূজা বলির লাগিয়া
নিয়ে গেছে। <মরি মরি কেঁদেছিল কত> {মরি মরি কেঁদেছিল কত}

**৩

অপর্ণা । <+++>
{চেয়েছিল চারিদিকে
ব্যাকুল নয়নে
ছুটিয়া এল না!} মূল্য তারা রেখে গেছে!
দরিদ্রজনের মর্ম্ম বেদনার মূল্য!
তাম্রখণ্ড কটা রাঙা আঙারের মত
দহিতেছে করতল! এই লও, প্রভু!
আজ্ঞা কর তারে ফিরে দিতে!
রাজা । জয়সিংহ!
জয়সিংহের প্রবেশ।
{Entrence right}
জয়সিংহ । কি আদেশ মহারাজ!
গোবিন্দমাণিক্য । ক্ষুদ্র ছাগশিশু
দরিদ্র এ বালিকার স্নেহের পুত্তলি,
তা’রে নাকি কেড়ে আনিয়াছ মার কাছে
বলি দিতে? <এ দান কি নেবেন জননী
প্রসন্ন দক্ষিণ হস্তে?>
{crosses over to অপর্ণা}
জয়সিংহ । কেমনে জানিব,
মহারাজ, কোথা হ’তে অনুচরগণ
আনে পশু দেবীর পূজার তরে!— হ্যাঁ গা,
কেন তুমি কাঁদিতেছ? আপনি নিয়েছে
যারে বিশ্বমাতা, তা’র তরে ক্রন্দন কি
শোভা পায়?
অপর্ণা । কে তোমার বিশ্বমাতা! মোর
শিশু চিনিবে না তা’রে। মা-হারা শাবক
জানে না সে আপন মায়েরে। আমি যদি
বেলা করে’ আসি, খায় না সে তৃণদল,

**৪

ডেকে ডেকে চায় পথপানে— কোলে করে’
নিয়ে তা’রে, ভিক্ষা-অন্ন কয় জনে ভাগ
করে খাই। আমি তা’র মাতা!
জয় । মহারাজ,
আপনার প্রাণ-অংশ দিয়ে, যদি তা’রে
বাঁচাইতে পারিতাম দিতাম বাঁচায়ে।
মা তাহারে নিয়েছেন— আমি তা’রে আর
ফিরাব কেমনে?
অপর্ণা । মা তাহারে নিয়েছেন?
মিছে কথা! রাক্ষসী নিয়েছে তা’রে!
জয় । ছি ছি!
ও কথা এনো না মুখে!
অপর্ণা । মা, তুমি নিয়েছ
কেড়ে দরিদ্রের ধন! রাজা যদি চুরি
করে, শুনিয়াছি নাকি, আছে জগতের
রাজা— তুমি যদি চুরি কর, কে তোমার
করিবে বিচার! মহারাজ, বল তুমি—
গোবিন্দ । বৎসে, আমি বাক্যহীন,— এত ব্যথা কেন,
এত রক্ত কেন, কে বলিয়া দিবে মোরে?
অপর্ণা । এই যে সোপান বেয়ে রক্তচিহ্ন দেখি
এ কি তারি রক্ত? ওরে বাছনি আমার!
মরি মরি, মোরে ডেকে কেঁদেছিল কত,
চেয়েছিল চারিদিকে ব্যাকুল নয়নে
কম্পিত কাতর বক্ষে, মোর প্রাণ কেন
যেথা ছিল সেথা হ’তে ছুটিয়া এল না?
জয়সিংহ । (প্রতিমার প্রতি)
আজন্ম পূজিনু তোরে তবু তোর মায়া
বুঝিতে পারিনে! করুণায় কাঁদে প্রাণ
মানবের,— দয়া নাই বিশ্বজননীর!

**৫

অপর্ণা । (জয়সিংহের প্রতি)
তুমি তো নিষ্ঠুর নহ— আঁখি-প্রান্তে তব
অশ্রু ঝরে মোর দুখে! তবে এস তুমি,
এ মন্দির ছেড়ে এস!
জয়সিংহ । (প্রতিমার প্রতি)
তোমার মন্দিরে এ কি নূতন সঙ্গীত
ধ্বনিয়া উঠিল আজি হে গিরিনন্দিনী,
করুণাকাতর কণ্ঠস্বরে! ভক্তহৃদি
অপরূপ বেদনায় উঠিল ব্যাকুলি!
— হে শোভনে, কোথা যাব এ মন্দির ছেড়ে!
কোথায় আশ্রয় আছে?
গোবিন্দ । যেথা আছে প্রেম!
জয়সিংহ । কোথা আছে প্রেম!— অয়ি ভদ্রে, এস তুমি
আমার কুটীরে। অতিথিরে দেবীরূপে
আজিকে করিব পূজা করিয়াছি পণ।
জয়সিংহ, অপর্ণার প্রস্থান {Exit centre}
হাসি ও তাতার প্রবেশ
হাসি । রাজা আমি এসেছি।
ধ্রুব । আমি এসেছি!
গোবিন্দ । দুটি ভাইবোন
যেন ধ্বনি প্রতিধ্বনি! কে তুমি চিনিতে আমি!
হাসি । বল্ ভাই, আমি “তাতা”!
{কোলে করে নেওয়া}
ধ্রুব । আমি “তাতা”।
হাসি । আমাদের তাতা। তুমি ওকে কি দিয়েছ <+++>

**৬

হাসি । নাম, মুখে আসে নাক! ও ত ধ্রুব নয়।
কি বলিস্ ভাই! তুই আমাদের তাতা!
ধ্রুব । আমি তাতা!
হাসি । আমি তোর দিদি!
ধ্রুব । তুমি দিদি!
{হাসি ধ্রুবকে হাত বাড়িয়ে কোলে নেবে।}
হাসি । চল্ ভাই মন্দিরে ঠাকুর দেখে আসি,
চল্! জান রাজা, আমি ওকে শিখিয়েছি
মন্দির বলিতে। ও আগে বলিত “নন্দি”।
তাতা ভাই বল্ দেখি মন্দির কোথায়?
ধ্রুব । ওই যে মন্দির!
হাসি । তাতা ভাই সব জানে।
চল্ ভাই! চল রাজা।
গোবিন্দ । এই হাত ধর।
(মন্দিরের সোপানের নিকট)
হাসি । এ কিসের দাগ রাজা?
গোবিন্দ । রক্তচিহ্ণ মাতঃ।
হাসি । মাগো এত রক্ত কেন?
গোবিন্দ । এত রক্ত কেন?
তুই কি শুধালি? কিম্বা শুধালে দেবী?
কিম্বা এ আমার আপন মর্ম্মের মাঝে

**৭

গোবিন্দ । আপনি উঠিল বেজে— “এত রক্ত কেন?”
তাইত মা, এত রক্ত কেন?
(মন্দিরের প্রতি) মাগো এত
রক্ত কেন?
হাসি । চল রাজা, এখন মন্দিরে যাই।
গোবিন্দ । না, না, বৎসে আজ থাক, আজ মন্দিরেতে নয়।
গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান {Exit centre}
হাসি । আয় ভাই আমরা দুজনে রক্ত মুছে ফেলি!
গুণবতীর প্রবেশ
গুণ । ওই তারা দুই ভাইবোন! ওরে তোরা <+++>
চুরি করে নিয়েছিস্ আমার সন্তান
তরে যে আসন ছিল! না আসিতে
আমার বাছারা তাহাদের পিতৃস্নেহ
পরে তোরা বসাইলি ভাগ! কে আছিস্
নিয়ে যা দুরন্ত দস্যুদের। যা যা তোরা,
শীঘ্র পলায়ন কর হেথা হ’তে।
হাসি ও ধ্রুবের প্রস্থান
রঘুপতির প্রবেশ
রঘুপতির প্রবেশ
প্রভু,
চিরদিন মা’র পূজা করি! জেনে শুনে
কিছু ত করিনি দোষ! পুণ্যের শরীর
মোর স্বামী মহাদেবসম— তবে কোন্
দোষ দেখে আমারে করিল মহামায়া
নিঃসন্তানশ্মশানচারিণী?

**৮

{রঘুপতি সোপানে আসীন}
রঘু । মার খেলা
কে বুঝিতে পারে বল? পাষাণ-তনয়া
ইচ্ছাময়ী,— সুখ দুঃখ তাঁরি ইচ্ছা! ধৈর্য্য
ধর! এবার তোমার নামে মা’র পূজা
হবে। প্রসন্ন হইবে শ্যামা।
গুণ । এবৎসর
পূজার বলির পশু আমি নিজে দিব।
করিনু মানৎ, মা যদি সন্তান দেন
বর্ষে বর্ষে দিব তাঁরে একশ’ মহিষ,
তিন শত ছাগ।
<রঘু । পূজার সময় হ’ল।>
(<উভয়ের> {গুণবতীর} প্রস্থান)
রঘুপতি ও গুণবতীর প্রস্থান
জনতার প্রবেশ। {গাহিতে গাহিতে প্রবেশ (ঝর ঝর রক্ত ঝরে)
ঝর ঝর রক্ত ঝরে}
<গনেশ । এবারে রক্ত মেখে নৃত্য করব। এবার বড় আনন্দ।
হারু । এবার ছেলে বুড়ো সবাই রাঙা হয়ে মায়ের সন্তান সাজব।
কালু । এ বছর রাণীমা তিনশো পাঁঠা, একশো এক মহিষ ঠাকুরণকে দিয়েছে রাণীমার জয় হোক্।
গনেশ । এবারে শ্যামা মা পেটভরে রক্ত খেয়ে নেবে।
জনতার গান
গনেশ । (নেপালের প্রতি) ওহে তোমারত দক্ষিণ দ থেকে পূজো দেখ্‌তে এসেছ! তোম আদের যে বড় জাঁক ছিল— কেমন! তোমাদের এমন ঠাকুরণ আছে?
নেপাল । ওরে সোনা দিয়ে হাত বাঁধিয়ে দিলেই কি ঠাকুরণ হয়? আমাদের <দ> দক্ষিণেশ্বরী জাগ্রত দেবতা। তোদের ঠাকুরণ পাঁঠা খেয়ে থাকে আমাদের>

**৯

<নেপাল । আমাদের মা আস্ত <+++> মানুষ গেলে!
হারু । শোন একবার কথা শোন! তোদের দেশে কি মানুষ আছে নাকি?
কানু । ওদের যেমন মানুষ তেম্‌নি ঠাকুরণ!
জন্মেজয় । কে হে বেল্লিক— আমাদের দেশে—
নেপাল । আরে তুই রোষ্! আমি এর জবাব দিচ্চি! বলি, ও আক্কেলমভ মানুষ যদি না থাক্‌বে তবে আমরা হলুম কোথা থেকে? আমরা কি ভুঁই ফুঁড়ে উঠেছি?
জন্মেজয় । বেশ জবাব দিয়েছ! আচ্ছা জবাব দিয়েছ! বেটার মুখের মত জবাব হয়েছে!
হারু । ওহে তোমরা সবাই সাক্ষী থাক আমাকে “বেটা” বলেছে!
নেপাল । শালা, আমাদের ঠাকুরণকে—
হারু । শুন্‌লে? সকলেই শুন্‌লে? ও ব্যক্তি আমাকে বেটা বলেছে, আবার এব্যক্তি আমাকে শালা <+++> বল্লে!
নেপাল, জন্মেজয় । দুশো বার বল্‌ব।
হারু । হ্যা, দেখ বাপু, নেই বা বল্লে! ওতে কি তোমাদের বড় সুখ্যাৎ হবে? আচ্ছা, আমি তোমাকে ভালমানুষের মত বাপু বলছি বাছা বল্‌চি, তুমি কেবল বল যে আমাকে বেটা বললি তা হলেই আজকের মত গোলমাল চুকে যায়।
কানু ও গনেশ । চলনা এখান থেকে বেরিয়ে মাঠে যাওয়া যাক্! দেখি কোন দল জেতে!>

**১০

<নেপাল, জন্মেজয় । চল না রাজি আছি!
হারু । তা যাওনা, তোমরা এগোও না! আমি আসচি! তামাক খেয়ে আসচি!
{দূতের প্রবেশ
জনতার প্রস্থান}
{2 +++ entrence <right> left}
গোবিন্দমাণিক্য, নক্ষত্রমাণিক্য, মন্ত্রী, নয়নরায়, চাঁদপালের {প্রথম <+++ right +++> entrence left} প্রবেশ
সকলে । জয় হোক্ মহারাজ
রঘুপতির প্রবেশ
{entrence মন্দির}
<রঘু । রাজার ভাণ্ডারে
এসেছি বলির পশু সংগ্রহ করিতে!
গোবিন্দ । মন্দিরেতে জীববলি এ বত্সর হ’তে
হইল নিষেধ।
নয়ন । বলি নিষেধ!
মন্ত্রী । নিষেধ!
নক্ষত্র । তাই তো! বলি নিষেধ!
রঘু । এ কি স্বপ্নে শুনি?
গোবিন্দ । স্বপ্নে নহে প্রভু! এতদিন স্বপ্নে ছিনু,
আজ জাগরণ! বালিকার মূর্ত্তি ধরে’
স্বয়ং জননী মোর বলে’ গিয়েছেন
জীবরক্ত সহে না তাঁহার!
রঘু । এতদিন
সহিল কী করে’? সহস্র বত্সর ধরে’
রক্ত করেছেন পান, আজি এ অরুচি?
গোবিন্দ । করেননি পান! মুখ ফিরাতেন দেবী
করিতে শোণিতপাত তোমরা যখন।
রঘু । মহারাজ, কি করিছ ভালো করে’ ভেবে
দেখো! শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে।
গোবিন্দ । সকল শাস্ত্রের বড় দেবীর আদেশ।>

**১১

<রঘু । একে ভ্রান্তি, তাহে অহঙ্কার! অজ্ঞ নর,
তুমি শুধু শুনিয়াছ দেবীর আদেশ,
আমি শুনি নাই?
<নক্ষত্র । তাই ত কি বল মন্ত্রী,
এ বড় আশ্চর্য্য! ঠাকুর শোনেন নাই?>
গোবিন্দ । দেবী-আজ্ঞা নিত্যকাল ধ্বনিছে জগতে।
সেই ত বধিরতম যে জন সে বাণী
শুনেও শুনে না।
রঘু । পাষণ্ড, নাস্তিক তুমি!
গোবিন্দ । ঠাকুর, সময় নষ্ট হয়। যাও এবে
মন্দিরের কাজে! প্রচার করিয়া দিয়ো
পথে যেতে যেতে, আমার ত্রিপুররাজ্যে
যে করিবে জীবহত্যা জীবজননীর
পূজাচ্ছলে, তারে দিব নির্ব্বাসন দণ্ড!
রঘু । এই কি হইল স্থির?
গোবিন্দ । স্থির এই!
রঘু । (উঠিয়া) তবে
উচ্ছন্ন! উচ্ছন্ন যাও!
<চাঁদ । (ছুটিয়া আসিয়া) হাঁ হাঁ! থাম! থাম!>
গোবিন্দ । <বোস চাঁদপাল!> ঠাকুর বলিয়া যাও!
মনোব্যথা লঘু করে’ যাও নিজ কাজে!
রঘু । তুমি কি ভেবেছ মনে ত্রিপুর-ঈশ্বরী
ত্রিপুরার প্রজা? প্রচারিবে তাঁর পরে
তোমার নিয়ম? হরণ করিবে তাঁর
বলি? হেন সাধ্য নাই তব! আমি আছি
মায়ের সেবক!
(প্রস্থান)
রঘুপতির প্রস্থান {Exit entrence right}
<নয়ন । ক্ষমা কর অধীনের
স্পর্দ্ধা মহারাজ! কোন অধিকারে, প্রভু,
জননীর বলি—
চাঁদ । শান্ত হও সেনাপতি!>>

**১২

<মন্ত্রী । মহারাজ, একেবারে করেছ কি স্থির?
আজ্ঞা আর ফিরিবে না?
গোবিন্দ । আর নহে মন্ত্রী;
বিলম্ব উচিত নহে বিনাশ করিতে
পাপ!
মন্ত্রী । পাপের কি এত পরমায়ু হবে?
কত শত বর্ষ ধরে যে প্রাচীন-প্রথা
দেবতাচরণতলে বৃদ্ধ হ’য়ে এল
সে কি পাপ হ’তে পারে?
(রাজার নিরুত্তরে চিন্তা)
নক্ষত্র । তাইত হে মন্ত্রী,
সে কি পাপ হ’তে পারে?
মন্ত্রী । পিতামহগণ
এসেছে পালন করে’ যত্নে ভক্তিভরে
সনাতন রীতি। তাঁহাদের অপমান
তা’র অপমানে!
(রাজার চিন্তা)
নয়ন । ভেবে দেখ মহারাজ,
যুগে যুগে যে পেয়েছে শত সহস্রের
ভক্তির সম্মতি, তাহারে করিতে নাশ
তোমার কি আছে অধিকার!
গোবিন্দ । (সনিশ্বাসে) থাক্ তর্ক!
যাও মন্ত্রী, আদেশ প্রচার কর গিয়ে
আজ হ’তে বন্ধ বলিদান।
[প্রস্থান]
গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান
মন্ত্রী । এ কি হ’ল!
নক্ষত্র । তাইত হে মন্ত্রী, এ কি হ’ল! শুনেছিনু
মগের মন্দিরে বলি নেই, অবশেষে
মগেতে হিন্দুতে ভেদ রহিল না কিছু!
কি বল হে চাঁদপাল, তুমি কেন চুপ?
চাঁদ । ভীরু আমি ক্ষুদ্র প্রাণী, বুদ্ধি কিছু কম,
না বুঝে পালন করি রাজার আদেশ।
সকলের প্রস্থান>

**১৩

জয়সিংহের প্রবেশ
জয় । মাগো, শুধু তুই আর আমি! এ মন্দিরে
সারা দিন আর কেহ নাই। সারা দীর্ঘ
দিন! মাঝে মাঝে কে আমারে ডাকে যেন!
তোর কাছে থেকে তবু একা মনে হয়!
(নেপথ্যে গান)
আমি একলা চলেছি এ ভবে—
আমায় পথের সন্ধান কে কবে?
জয় । মাগো, এ কি মায়া! দেবতারে প্রাণ দেয়
মানবের প্রাণ। এইমাত্র ছিলে তুমি
নির্ব্বাক্ নিশ্চল— উঠিলে জীবন্ত হ’য়ে,
সন্তানের কণ্ঠস্বরে সজাগ জননী!
অপর্ণার প্রবেশ
গান গাহিতে গাহিতে অপর্ণার প্রবেশ
আমি এক্‌লা চলেছি এ ভবে,
আমায় পথের সন্ধান কে কবে?
ভয় নেই, ভয় নেই,
যাও # আপন মনেই,
যেমন, # এক্‌লা মধুপ ধেয়ে যায়
কেবল ফুলের সৌরভে!
জয় । কেবলি একেলা! <দক্ষিণ বাতাস যদি
বন্ধ হ’য়ে যায়, ফুলের সৌরভ যদি
নাহি আসে, দশদিক্ জেগে উঠে যদি
দশটি সন্দেহ সম, তখন কোথায়
সুখ, কোথা পথ?> জান কি একেলা কারে
বলে?
অপর্ণা । জানি। যবে বসে’ আছি ভরা মনে
দিতে চাই নিতে কেহ নাই!
জয় । সৃজনের
আগে দেবতা যেমন একা! তাই বটে!
তাই বটে! মনে হয় এ জীবন বড়
বেশি আছে,— যত বড় তত শূন্য, তত
আবশ্যকহীন!

**১৪

অপর্ণা । জয়সিংহ, তুমি বুঝি
একা! তাই দেখিয়াছি কাঙাল যে জন
তাহারো কাঙাল তুমি! যে তোমার সব
নিতে পারে, তা’রে তুমি খুঁজিতেছ যেন!
জয় । ওই আসিছেন
মোর গুরুদেব।
অপর্ণা । আমি তবে সরে’ যাই
অন্তরালে। ব্রাহ্মণেরে বড় ভয় করি।
কি কঠিন তীব্রদৃষ্টি! কঠিন ললাট
পাষাণ সোপান যেন দেবীমন্দিরের।
(অপর্ণার প্রস্থান)
অপর্ণার প্রস্থান
জয় । কঠিন? কঠিন বটে! বিধাতার মত!
কঠিনতা নিখিলের অটল নির্ভর।
(রঘুপতির প্রবেশ)
রঘুপতির প্রবেশ
জয় । (পা ধুইবার জল প্রভৃতি অগ্রসর করিয়া)
গুরুদেব!
রঘু । যাও, যাও!
জয় । আনিয়াছি জল।
রঘু । থাক্, রেখে দাও জল!
জয় । বসন!
রঘু । কে চাহে
বসন!
জয় । অপরাধ করেছি কি?
রঘু । আবার!
কে নিয়েছে অপরাধ তব?
ঘোর কলি।
এসেছে ঘনায়ে! বাহুবল রাহুসম
ব্রহ্মতেজ গ্রাসিবারে চায়— সিংহাসন
তোলে শির যজ্ঞবেদী পরে! হায়, হায়,
কলির দেবতা তোমরাও চাটুকর
সভাসদ্‌সম, নতশিরে রাজ-আজ্ঞা

**১৫

রঘু । বহিতেছ? চতুর্ভুজা, চারিহস্ত আছ
জোড় করি’! বৈকুণ্ঠ কি আবার নিয়েছে
কেড়ে দৈত্যগণ? গিয়েছে দেবতা যত
রসাতলে? শুধু দানবে মানবে মিলে
বিশ্বের রাজত্ব দর্পে করিতেছে ভোগ?
দেবতা না যদি থাকে ব্রাহ্মণ রয়েছে।
ব্রাহ্মণের রোষযজ্ঞে দণ্ড সিংহাসন
হবিকাষ্ঠ হবে।
(জয়সিংহের নিকট গিয়া সস্নেহে) বত্স, আজ করিয়াছি
রুক্ষ আচরণ তোমাপরে, চিত্ত বড়
ক্ষুব্ধ মোর।
জয় । কি হয়েছে প্রভু?
রঘু । কি হয়েছে?
শুধাও অপমানিত ত্রিপুরেশ্বরীরে!
এই মুখে কেমনে বলিব কি হয়েছে?
জয় । কে করেছে অপমান?
রঘু । গোবিন্দমাণিক্য।
জয়সিংহ । গোবিন্দমাণিক্য? প্রভু, কারে অপমান?
রঘু । কারে! তুমি, আমি, সর্ব্বশাস্ত্র, সর্ব্বদেশ,
সর্ব্বকাল, সর্ব্বদেশকালঅধিষ্ঠাত্রী
মহাকালী, সকলেরে করে অপমান
ত্রিপুরার ক্ষুদ্র সিংহাসনে বসি।
দেবীর পূজার বলি করেছে নিষেধ।
জয় । গোবিন্দমাণিক্য!
রঘু । হাঁগো, হাঁ, তোমার রাজা গোবিন্দমাণিক্য!
তোমার সকল শ্রেষ্ঠ— তোমার প্রাণের
অধীশ্বর! অকৃতজ্ঞ! পালন করিনু
এত যত্নে স্নেহে তোরে শিশুকাল হ’তে,
আমা চেয়ে প্রিয়তর আজ তোর কাছে
গোবিন্দমাণিক্য?
জয় । প্রভু, পিতৃকোলে বসি
আকাশে বাড়ায় হাত ক্ষুদ্র মুগ্ধ শিশু

**১৬

জয় । পূর্ণচন্দ্রপানে— দেব, তুমি পিতা মোর,
পূর্ণশশী মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য!
কিন্তু এ কি বকিতেছি? কী কথা শুনিনু?
মায়ের পূজার বলি নিষেধ করেছে
রাজা? এ আদেশ কে মানিবে?
রঘু । না মানিলে
নির্ব্বাসন।
জয় । মাতৃপূজাহীন রাজ্য হ’তে
নির্বাসন দণ্ড নহে। এ প্রাণ থাকিতে
অসম্পূর্ণ নাহি র’বে জননীর পূজা!
রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান
গুণবতী ও পরিচারিকার প্রবেশ
{Entrance left}
গুণ । কি বলিস্? মন্দিরের দুয়ার হইতে
রাণীর পূজার বলি ফিরায়ে দিয়াছে?
একদেহে কত মুণ্ড আছে তা’র? কে সে
দুরদৃষ্ট?
পরি । বলিতে সাহস নাহি মানি—
গুণ । বলিতে সাহস নাহি? এ কথা বলিলি
কি সাহসে? আমাচেয়ে কারে তোর ভয়?
পরি । ক্ষমা কর!
গুণ । কাল সন্ধেবেলা ছিনু রাণী;
কাল সন্ধেবেলা বন্দিগণ করে’ গেছে
স্তব, বিপ্রগণ করে’ গেছে আশীর্ব্বাদ,
ভৃত্যগণ করজোড়ে আজ্ঞা ল’য়ে গেছে,
একরাত্রে উলটিল সকল নিয়ম?
দেবী পাইল না পূজা, রাণীর মহিমা
অবনত? ত্রিপুরা কি স্বপ্নরাজ্য ছিল?
ত্বরা করে’ ডেকে আনো ব্রাহ্মণ ঠাকুরে!
(পরিচারিকার প্রস্থান)
<{Exit centre}>

**১৭

{Entrence Entrence Right}
গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
গুণ । মহারাজ, শুনিতেছি মার দ্বার হ’তে
আমার পূজার বলি ফিরায়ে দিয়েছে।
গোবিন্দ । জানি তাহা!
গুণ । জান তুমি? নিষেধ করনি
তবু? জ্ঞাতসারে মহিষীর অপমান!
গোবিন্দ । তা’রে ক্ষমা কর প্রিয়ে?
গুণ । দয়ার শরীর
তব, কিন্তু মহারাজ, এ ত দয়া নয়,
এ শুধু কাপুরুষতা! দয়ায় দুর্ব্বল
তুমি, নিজ হাতে দণ্ড দিতে নাহি পার
যদি, আমি দণ্ড দিব। বল মোরে কে সে
অপরাধী!
গোবিন্দ । দেবি, আমি! অপরাধ আর
কিছু নহে, তোমারে দিয়েছি ব্যথা এই
অপরাধ।
গুণ । কি বলিছ মহারাজ!
গোবিন্দ । আজ
হ’তে দেবতার নামে জীবরক্তপাত
আমার ত্রিপুররাজ্যে হয়েছে নিষেধ।
গুণ । কাহার নিষেধ?
গোবিন্দ । জননীর।
গুণ । কে শুনেছে?
গোবিন্দ । আমি।
গুণ । তুমি? মহারাজ, শুনে হাসি আসে!
রাজদ্বারে এসেছেন ভুবন-ঈশ্বরী
জানাইতে আবেদন!
গোবিন্দ । হেসোনা মহিষী!
জননী আপনি এসে সন্তানের প্রাণে
বেদনা জানায়েছেন, আবেদন নহে!
গুণ । কথা রেখে দাও মহারাজ। মন্দিরের
বাহিরে তোমার রাজ্য, যেথা তব আজ্ঞা
নাহি চলে, সেথা আজ্ঞা নাহি দিয়ো!

**১৮

গোবিন্দ । মার
আজ্ঞা, মোর আজ্ঞা নহে!
গুণ । শুনিয়াছি আপনার পাপপুণ্য
আপনার কাছে। তুমি থাক আপনার
অসংশয় নিয়ে— আমার দুয়ার ছাড়,
আমার পূজার বলি আমি নিয়ে যাই
আমার মায়ের কাছে!
গোবিন্দ । দেবী! জননীর
আজ্ঞা পারি না লঙ্ঘিতে।
গুণ । আমিও পারি না!
মা’র কাছে আছি প্রতিশ্রুত। সেই মত
যথাশাস্ত্র যথাবিধি পূজিব তাঁহারে,
যাও, তুমি যাও।
গোবিন্দ । যে আদেশ মহারাণী।
গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান
{Exit entrence right}
রঘুপতির প্রবেশ
রঘুপতির প্রবেশ
গুণ । ঠাকুর, আমার পূজা ফিরায়ে দিয়েছে
মাতৃদ্বার হ’তে।
রঘু । মহারাণী, মার পূজা
ফিরে গেছে, নহে সে তোমার! উঞ্ছবৃত্ত
দরিদ্রের ভিক্ষালব্ধ পূজা, রাজেন্দ্রাণী,
তোমার পূজার চেয়ে ন্যূন নহে! কিন্তু
এই বড় সর্ব্বনাশ, মা’র পূজা ফিরে
গেছে! এই বড়ো সর্ব্বনাশ, রাজদর্প
ক্রমে স্ফীত হ’য়ে করিতেছে অতিক্রম
পৃথিবীর রাজত্বের সীমা— বসিয়াছে
দেবতার দ্বার রোধ করি— জননীর
ভক্তদের প্রতি দুই আঁখি রাঙাইয়া!
গুণবতী । কি হবে ঠাকুর?

**১৯

রঘু । জানেন তা’ মহামায়া!
এই শুধু জানি— যে সিংহাসনের ছায়া
পড়েছে মায়ের দ্বারে— ফুত্কারে ফাটিবে
সেই দম্ভমঞ্চখানি জলবিম্বসম!
যুগে যুগে রাজপিতাপিতামহ মিলে
ঊর্দ্ধপানে তুলিয়াছে যে রাজমহিমা
অভ্রভেদী করে, মুহূর্ত্তে হইয়া যাবে
ধূলিসাৎ বজ্রদীর্ণ দগ্ধ ঝঞ্ঝাহত।
গুণ । রক্ষা কর, রক্ষা কর প্রভু!
রঘু । হা, হা, আমি
রক্ষা করিব তোমারে! যে প্রবল রাজা
স্বর্গেমর্ত্ত্যে প্রচারিছে আপন শাসন
তুমি তাঁরি রাণী! দেব ব্রাহ্মণেরে যিনি—
ধিক্, ধিক্, শতবার! ধিক্ লক্ষ বার!
কলির ব্রাহ্মণে ধিক্! ব্রহ্মশাপ কোথা!
ব্যর্থ ব্রহ্মতেজ শুধু বক্ষে আপনার
আহত বৃশ্চিক সম আপনি দংশিছে!
মিথ্যা ব্রহ্ম আড়ম্বর!
(পৈতা ছিঁড়িতে উদ্যত)
গুণ । কি কর কি কর
দেব। রাখ, রাখ, দয়া কর নির্দ্দোষীরে!
রঘু । ফিরায়ে দে ব্রাহ্মণের অধিকার!
গুণ । দিব!
যাও প্রভু, পূজা কর মন্দিরেতে গিয়ে,
হবে নাকো পূজার ব্যাঘাত!
রঘু । যে আদেশ
রাজ-অধিশ্বরী! দেবতা কৃতার্থ হ’ল
তোমারি আদেশবলে, ফিরে পেল পুন
ব্রাহ্মণ আপন তেজ! ধন্য তোমরাই,
যত দিন নাহি জাগে কল্কি-অবতার।
[\সকলের প্রস্থান\]

**২০

[\জনতার প্রবেশ\]
দক্ষিণদল
একদল লোকের প্রবেশ
নেপাল । কোথায় হে, তোমাদের তিন শো পাঁঠা, একশোএক মোষ! একটা টিক্‌টিকির ছেঁড়া নেজটুকু পর্য্যন্ত দেখ্‌বার জো নাই! বাজ্‌নাবাদ্যি গেল কোথায়, সব যে হাঁ হাঁ করচে! খরচপত্র করে’ পূজো দেখ্‌তে এলুম, আচ্ছা শাস্তি হয়েছে!
গণেশ । দেখ্ মন্দিরের সাম্‌নে দাঁড়িয়ে অমন করে’ বলিস্‌নে! মা পাঁঠা পায় নি, এবার জেগে উঠে তোদের একএকটাকে ধরে’ ধরে’ মুখে পুরবে!
হারু । কেন! গেল বছরে বাছারা সব ছিলে কোথায়? আর সেই ওবছর, যখন ব্রতসাঙ্গ করে’ রাণীমা পূজো দিয়েছিল, তখন কি তোদের পায়ে কাঁটা ফুটেছিল? তখন একবার দেখে যেতে পারনি? রক্তে যে গোমতী রাঙা হ’য়ে গিয়েছিল? আর অলুক্ষুনে বেটারা এসেছিস্, আর মায়ের খোরাক্ পর্য্যন্ত বন্ধ হ’য়ে গেল। তোদের একটাকে ধরে’ মার কাছে নিবেদন করে’ দিলে মনের খেদ মেটে।
কানু । আর ভাই, মিছে রাগ করিস্! আমাদের কি আর বল্‌বার মুখ আছে? তাহ’লে কি আর দাঁড়িয়ে ও কথা শুনি!
±দক্ষিণদলের প্রস্থান ও উত্তরদল±

**২১

[\রঘুপতি, নয়নরায় ও জয়সিংহের প্রবেশ\]
রঘুপতি, নয়নরায় ও জয়সিংহের প্রবেশ
রঘু । মা’র পরে ভক্তি নাই তব?
নয়ন । হেন কথা
কার সাধ্য বলে? ভক্তবংশে জন্ম মোর!
রঘু । সাধু, সাধু,! তবে তুমি মায়ের সেবক,
আমাদেরি লোক।
নয়ন । প্রভু, মাতৃভক্ত যাঁরা
আমি তাঁহাদেরি দাস!
রঘু । সাধু! ভক্তি তব
হউক অক্ষয়! ভক্তি তব বাহুমাঝে
করুক্ সঞ্চার অতি দুর্জ্জয় শকতি!
ভক্তি তব তরবারী করুক্ শাণিত,
বজ্রসম দিক্ তাহে তেজ! ভক্তি তব
হৃদয়েতে করুক্ বসতি, পদমান
সকলের উচ্চে।
নয়ন । ব্রাহ্মণের আশীর্ব্বাদ
ব্যর্থ হইবে না।
রঘু । শুন তবে সেনাপতি
তোমার সকল বল কর একত্রিত
মা’র কাজে! নাশ কর মাতৃবিদ্রোহীরে!
নয়ন । যে আদেশ প্রভু! কে আছে মায়ের শত্রু?
রঘুপতি । গোবিন্দমাণিক্য।
নয়ন । আমাদের মহারাজ?

**২২

রঘু । ল’য়ে তব সৈন্যদল, আক্রমণ কর
তা’রে!
নয়ন । ধিক্ পাপপরামর্শ! প্রভু, এ কি
পরীক্ষা আমারে?
রঘু । পরীক্ষাই বটে! কার
ভৃত্য তুমি, এবার পরীক্ষা হবে তা’র।
ছাড় চিন্তা, ছাড় দ্বিধা, কাল নাহি আর,
ত্রিপুরেশ্বরীর আজ্ঞা হতেছে ধ্বনিত
প্রলয়ের শৃঙ্গসম— ছিন্ন হ’য়ে গেছে
আজি সকল বন্ধন।
নয়ন । নাই চিন্তা, নাই
কোনো দ্বিধা। যে পদে রেখেছে দেবী, আমি
তাহে রয়েছি অটল।
<রঘু । সাধু!>
নয়ন । এত আমি
নরাধম জননীর সেবকের মাঝে,
মোর পরে হেন আজ্ঞা? আমি হব
বিশ্বাসঘাতক? আপনি দাঁড়ায়ে আছে
বিশ্বমাতা— হৃদয়ের বিশ্বাসের পরে,
সেই তাঁর অটল আসন, আপনি তা’
ভাঙিতে বলিবে দেবী আপনার মুখে?
তাহা হ’লে আজ যাবে রাজা, কাল দেবী,
মনুষ্যত্ব ভেঙে পড়ে’ যাবে, জীর্ণভিত্তি
অট্টালিকা সম!
জয় । ধন্য, সেনাপতি ধন্য!
রঘু । ধন্য বটে তুমি! কিন্তু এ কি ভ্রান্তি তব!
যে রাজা বিশ্বাসঘাতী জননীর কাছে,
তা’র সাথে বিশ্বাসের বন্ধন কোথায়?
নয়ন । কি হইবে মিছে তর্কে? বুদ্ধির বিপাকে
চাহিনা পড়িতে। আমি জানি এক পথ
আছে— সেই পথ বিশ্বাসের পথ! সেই
সিধে পথ বেয়ে চিরদিন চলে’ যাবে
অবোধ অধমভৃত্য এ নয়ন রায়!

**২৩

জয় । চিন্তা কেন দেব? এমনি বিশ্বাস-বলে
মোরাও করিব কাজ। কারে ভয় প্রভু?
সৈন্য-বলে কোন্ কাজ? অস্ত্র কোন্ ছার!
যার পরে রয়েছে যে ভার— বল তা’র
আছে সে কাজের। করিবই মা’র পূজা
যদি সত্য মায়ের সেবক হই মোরা!
চল প্রভু,— বাজাই মায়ের ডঙ্কা, ডেকে
আনি পুরবাসিগণে। মন্দিরের দ্বার
খুলে দিই!— ওরে আয় তোরা, আয়, আয়,
অভয়ার পূজা হবে— নির্ভয়ে আয়রে
তোরা মায়ের সন্তান! আয় পুরবাসী!
? [\রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান\]
পুরবাসিগণের প্রবেশ
[\জনতার প্রবেশ\]
অক্রূর । ওরে আয়রে আয়!
সকলে । জয় মা!
হারু । <আয়রে মায়ের সাম্‌নে বাহু তুলে নৃত্য করি।> {এত রঙ্গ শিখেছ কোথায়}
<সকলে । জয় মা!
গণেশ । আর ভয় নেই!
কানু । ওরে সেই দক্ষিণদ’র মানুষগুলো এখন গেল কোথায়!
গণেশ । মায়ের ঐশ্বর্য্য বেটাদের সইল না। তা’রা ভেগেছে!
হারু । কেবল মায়ের ঐশ্বর্য নয়, আমি তাদের এম্‌নি শাসিয়ে দিয়েছি, তা’রা আর এমুখো হবে না। বুঝ্‌লে অক্রূর দা, আমার মামাতো-ভাই দফাদারের নাম করবামাত্র তাদের মুখ চূণ হ’য়ে গেল।
অক্রূর । আমাদের নিতাই সেদিন তাদের খুব কড়া কড়া দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। ওই যার সেই ছুঁচপানা মুখ সেই বেটা তেড়ে উত্তর দিতে এসেছিল; আমাদের নিতাই বল্লে, “ওরে তোরা দক্ষিণদেশে থাকিস্, তোরা উত্তরের কি জানিস্? উত্তর দিতে এসেছিস্, উত্তরের জানিস্ কি?” শুনে আমরা হেসে কে কার গায়ে পড়ি।
গণেশ । ইদিকে ঐ ভালোমানুষ কিন্তু নিতাইয়ের সঙ্গে কথায় আঁট্‌বার জো নেই।
হারু । নিতাই আমার পিসে হয়।>

**২৪

<কানু । শোন একবার কথা শোন! নিতাই আবার তোর পিসে হ’ল কবে?
হারু । তোমরা আমার সকল কথাই ধরতে আরম্ভ করেছ। আচ্ছা, পিসে নয়ত পিসে নয়! তা’তে তোমার সুখটা কি হ’ল? আমার হ’ল না বলে’ কি তোমারি পিসে হ’ল?>
রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রবেশ
রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রবেশ
রঘু । শুন্‌লেম সৈন্য আস্‌চে। জয়সিংহ, অস্ত্র নিয়ে তুমি এখানে দাঁড়াও। তোরা আয়, তোরা এইখানে দাঁড়া! মন্দিরের দ্বার আগলাতে হবে। আমি তোদের অস্ত্র এনে দিচ্ছি!
গণেশ । অস্ত্র কেন ঠাকুর?
রঘু । মায়ের পূজো বন্ধ করবার জন্যে রাজার সৈন্য আস্‌চে।
হারু । সৈন্য আস্‌চে! <প্রভু, তবে প্রণাম হই!> {সে কি কথা!}
<কানু । আমরা ক’জনা, সৈন্য এলে কি করতে পারব?
হারু । কর্ত্তে সবই পারি— কিন্তু সৈন্য এলে এখানে জায়গা হবে কোথায়? লড়াই ত পরের কথা, এখানে দাঁড়াব কোন্‌খানে?
অক্রূর । তোরা কথা রেখে দে। দেখ্‌চিস্ নে, প্রভু রাগে কাঁপ্‌চেন। তা ঠাকুর অনুমতি করেন ত আমাদের দলবল সমস্ত ডেকে নিয়ে আসি।
হারু । সেই ভালো। অমনি আমার মামাতো-ভাইকে ডেকে আনি। কিন্তু আর একটুও বিলম্ব করা উচিত নয়।
(সকলের প্রস্থানোদ্যম)
রঘু । (সরোষে) দাঁড়া তোরা!
জয় । (করজোড়ে) যেতে দাও প্রভু— প্রাণভয়ে ভীত এরা
বুদ্ধিহীন— আগে হ’তে রয়েছে মরিয়া।
আমি আছি মায়ের সৈনিক। এক দেহে
সহস্র সৈন্যের বল। অস্ত্র থাক পড়ে’!
ভীরুদের যেতে দাও!
রঘু । (স্বগত) সে কাল গিয়েছে!
অস্ত্র চাই— অস্ত্র চাই— শুধু ভক্তি নয়!
(প্রকাশ্যে) জয়সিংহ, তবে বলি আন, করি পূজা!>

±{আমরা ভয় করিনে সৈন্যকে। <মানিনে> আমরা ডেকে আনব আমাদের দলবল।}±

**২৫

(বাহিরে বাদ্যোদ্যম)
জয় । সৈন্য নহে প্রভু, আসিছে রাণীর পূজা!
রাণীর অনুচর ও পুরবাসিগণের প্রবেশ
সকলে । <ওরে ভয় নেই—সৈন্য কোথায়?> মার পূজা আস্‌চে।
<হারু । আমরা আছি খবর পেয়েছে, সৈন্যেরা শীঘ্র এ দিকে আস্‌চে না।
কানু । ঠাকুর, রাণীমা পূজো পাঠিয়েছেন।>
রঘু । জয়সিংহ, শীঘ্র পূজার আয়োজন কর।
(জয়সিংহের প্রস্থান)
[\জয়সিংহের প্রস্থান\]
{[/Entrence attendants herald\]}
গোবিন্দমাণিকের প্রবেশ
(পুরবাসিগণের নৃত্য গীত)
গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
গোবিন্দ । চলে’ যাও হেথা হ’তে— নিয়ে যাও বলি!
রঘুপতি, শোন নাই আদেশ আমার?
রঘু । শুনি নাই।
গোবিন্দ । তবে তুমি এ রাজ্যের নহ।
রঘুপতি । নহি আমি! আমি আছি যেথা, সেথা এলে
রাজদণ্ড খসে’ যায় রাজহস্ত হ’তে,
মুকুট ধূলায় পড়ে’ লুটে! কে আছিস,
আন্ মা’র পূজা।
(বাদ্যোদ্যম)
গোবিন্দ । চুপ কর্! (অনুচরের প্রতি) কোথা আছে
সেনাপতি, ডেকে আন! হায়, রঘুপতি,
অবশেষে সৈন্য দিয়ে ঘিরিতে হইল
ধর্ম্ম! লজ্জা হয় ডাকিতে সৈনিকদল,
বাহুবল দুর্ব্বলতা করায় স্মরণ!
রঘু । অবিশ্বাসী, সত্যই কি হয়েছে ধারণা
কলিযুগে ব্রহ্মতেজ গেছে— তাই এত
দুঃসাহস? যায় নাই! যে দীপ্ত অনল

±{+++ প্রস্থান}±

**২৬

জ্বলিছে অন্তরে, সে তোমার সিংহাসনে
নিশ্চয় লাগিবে! নতুবা এ মনানলে
ছাই করে’ পুড়াইব সব শাস্ত্র, সব
ব্রহ্মগর্ব্ব, সমস্ত তেত্রিশকোটি মিথ্যা।
আজ নহে মহারাজ রাজ অধিরাজ
এই দিন মনে কোরো আর একদিন।
<নয়ন রায় ও চাঁদপালের প্রবেশ
নয়ন রায় ও চাঁদপালের প্রবেশ
গোবিন্দ । (নয়নের প্রতি) সৈন্য ল’য়ে থাক হেথা নিষেধ করিতে
জীববলি।
নয়ন । ক্ষমা কর অধম কিঙ্করে।
অক্ষম রাজার ভৃত্য দেবতা মন্দিরে।
যত দূর যেতে পারে রাজার প্রতাপ
মোরা ছায়া সঙ্গে যাই!
চাঁদ । থাম সেনাপতি,
দীপশিখা থাকে এক ঠাঁই, দীপালোক
যায় বহুদূরে। রাজইচ্ছা যেথা যাবে
সেথা যাব মোরা।
গোবিন্দ । সেনাপতি, মোর আজ্ঞা
তোমার বিচারাধীন নহে! ধর্ম্মাধর্ম্ম
লাভক্ষতি রহিল আমার, কার্য্য শুধু
তব হাতে।
নয়ন । এ কথা হৃদয় নাহি মানে।
মহারাজ ভৃত্য বটে, তবুও মানুষ
আমি। আছে বুদ্ধি, আছে ধর্ম্ম, আছ প্রভু,
আছেন দেবতা!
গোবিন্দ । তবে ফেল অস্ত্র তব।
চাঁদপাল, তুমি হ’লে সেনাপতি, দুই
পদ রহিল তোমার। সাবধানে সৈন্য
ল’য়ে মন্দির করিবে রক্ষা!>

**২৭

<চাঁদ । যে আদেশ
মহারাজ!
গোবিন্দ । নয়ন, তোমার অস্ত্র দাও
চাঁদপালে!
নয়ন । চাঁদপালে? কেন মহারাজ?
এ অস্ত্র, তোমার পূর্ব্ব রাজপিতামহ
দিয়েছেন আমাদের পিতামহে। ফিরে
নিতে চাও যদি, তুমি লও।
চাঁদ । কথা আছে ভাই!
নয়ন । ধিক্!
চুপ কর! মহারাজ, বিদায় হলেম!
গোবিন্দ । ক্ষুদ্র স্নেহ নাই রাজকাজে! দেবতার
কার্য্যভার তুচ্ছ মানবের পরে, হায়
কি কঠিন!
রঘু । এমনি করিয়া ব্রহ্মশাপ
ফলে, বিশ্বাসী হৃদয় ক্রমে দূরে যায়
ভেঙে যায় দাঁড়াবার স্থান।>
{[\জয়সিংহ\] Entrence right}
জয়সিংহের প্রবেশ
জয় । আয়োজন
হয়েছে পূজার। প্রস্তুত হয়েছে বলি।
গোবিন্দ । বলি কার তরে?
জয় । মহারাজ, তুমি হেথা!
তবে শোন নিবেদন— একান্ত মিনতি
যুগল চরণতলে, প্রভু, ফিরে লও
তব গর্ব্বিত আদেশ! মানব হইয়া
দাঁড়ায়োনা দেবীরে আচ্ছন্ন করি—
রঘু । ধিক্!
জয়সিংহ, ওঠ, ওঠ। চরণে পতিত

**২৮

কার কাছে? আমি যার গুরু, এ সংসারে
এই পদতলে তা’র একমাত্র স্থান!
মুঢ়, ফিরে দেখ্— গুরুর চরণ ধরে’
ক্ষমা ভিক্ষা কর! রাজার আদেশ নিয়ে
করিব দেবীর পূজা,— করাল কালিকা,
এত কি হয়েছে তোর অধঃপাত? থাক্
পূজা, থাক্ বলি,— দেখিব রাজার দর্প
কত দিন থাকে! চলে’ এস জয়সিংহ।
[\গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান\]

±আমার আঁধার ভালো±

**২৯

[\রঘুপতি জয়সিংহ ও নক্ষত্র রায়ের প্রবেশ\]
রঘুপতি জয়সিংহ ও নক্ষত্র রায়
নক্ষত্র । কি জন্য ডেকেছ গুরুদেব?
রঘু । কাল রাত্রে
স্বপন দিয়েছে দেবী, তুমি হবে রাজা।
নক্ষত্র । আমি হব রাজা! হা, হা! বল কি ঠাকুর!
রাজা হব? এ কথা নূতন শোনা গেল!
রঘু । তুমি রাজা হবে।
নক্ষত্র । বিশ্বাস না হয় মোর।
রঘু । দেবীর স্বপন সত্য। রাজটীকা পাবে
তুমি, নাহিক সন্দেহ!
নক্ষত্র । নাহিকো সন্দেহ!
কিন্তু যদি নাই পাই!
রঘু । আমার কথায়
অবিশ্বাস!
নক্ষত্র । অবিশ্বাস কিছুমাত্র নেই,
কিন্তু দৈবাতের কথা যদি নাই হয়!
রঘু । অন্যথা হবে না কভু!
নক্ষত্র । অন্যথা হবে না!
দেখো প্রভু, কথা যেন ঠিক থাকে শেষে!
রাজা হ’য়ে মন্ত্রীটারে দেব দূর করে’,
সর্ব্বদাই দৃষ্টি তা’র রয়েছে পড়িয়া
আমা পরে, যেন সে বাপের পিতামহ!
বড় ভয় করি তা’রে— বুঝেছ ঠাকুর,
তোমারে করিব মন্ত্রী।
রঘু । মন্ত্রীত্বের পদে
পদাঘাত করি আমি!
নক্ষত্র । আচ্ছা, জয়সিংহ
মন্ত্রী হবে। কিন্তু হে ঠাকুর, সবি যদি
জান তুমি, বল দেখি কবে রাজা হব!

**৩০

রঘুপতি । রাজরক্ত চান্ দেবী।
নক্ষত্র । রাজরক্ত চান!
রঘু । রাজরক্ত আগে আন পরে রাজা হবে।
নক্ষত্র । পাব কোথা!
রঘু । ঘরে আছে গোবিন্দমাণিক্য
তাঁরি রক্ত চাই!
নক্ষত্র । তাঁরি রক্ত চাই!
রঘু । স্থির
হ’য়ে থাক জয়সিংহ, হয়োনা চঞ্চল!
— বুঝেছ কি? শোনো তবে,— গোপনে তাঁহারে
বধ করে’ আনিবে সে তপ্ত রাজরক্ত
দেবীর চরণে।
জয়সিংহ, স্থির যদি
না থাকিতে পার, চলে’ যাও অন্য ঠাঁই!
— বুঝেছ নক্ষত্ররায়, দেবীর আদেশ
রাজরক্ত চাই— শ্রাবণের শেষ রাত্রে।
তোমরা রয়েছ দুই রাজভ্রাতা— জ্যেষ্ঠ
যদি অব্যাহতি পায়— তোমার শোণিত
আছে। তৃষিত হয়েছে যবে মহাকালী,
তখন সময় আর নাই বিচারের।
নক্ষত্র । সর্ব্বনাশ! হে ঠাকুর, কাজ কি রাজত্বে!
রাজরক্ত থাক্ রাজদেহে, আমি যাহা
আছি সেই ভালো!
রঘু । মুক্তি নাই! মুক্তি নাই
কিছুতেই। রাজরক্ত আনিতেই হবে!
নক্ষত্র । বলে’ দাও, হে ঠাকুর, কি করিতে হবে!
রঘু । প্রস্তুত হইয়া থাক। যখন যা’ বলি
অবিলম্বে সাধন করিবে। কার্য্যসিদ্ধি
যত দিন নাহি হয় বন্ধ রেখো মুখ!
এখন বিদায় হও!
নক্ষত্র । হে মা কাত্যায়নী!
{[\নক্ষত্র প্রস্থান\]}

**৩১

জয় । এ কি শুনিলাম! দয়াময়ী, এ কি
কথা! তোর আজ্ঞা! ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা!
বিশ্বের জননি! গুরুদেব! হেন আজ্ঞা
মাতৃআজ্ঞা বলে’ করিলে প্রচার!
রঘু । আর
কি উপায় আছে বল!
জয় । উপায়! কিসের
উপায় প্রভু! হা ধিক্! জননি, তোমার
হস্তে খড়্গ নাই? রোষে তব বজ্রানল
নাহি চণ্ডি? তব ইচ্ছা উপায় খুঁজিছে,
খুঁড়িছে সুরঙ্গপথ চোরের মতন
রসাতলগামী? এ কি পাপ!
রঘু । পাপপুণ্য
তুমি কিবা জান।
জয় । শিখেছি তোমারি কাছে।
রঘু । তবে এস বত্স, আর এক শিক্ষা দিই!
পাপপুণ্য কিছু নাই। কে বা ভ্রাতা, কে বা
আত্মপর! কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ!
এ জগৎ মহা হত্যাশালা! জাননা কি
প্রত্যেক পলকপাতে লক্ষকোটি প্রাণী
চির আঁখি মুদিতেছে! সে কাহার খেলা?
হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি!
প্রতিপদে চরণে দলিত শত কীট;
তাহারা কি জীব নহে? রক্তের অক্ষরে
অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল
বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস।
হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে,
হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে,
অগাধ সাগর-জলে, নির্ম্মল আকাশে,
হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা খেলাচ্ছলে,
হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে,

**৩২

চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে
ঊর্দ্ধশ্বাসে প্রাণপণে— ব্যাঘ্রের আক্রমে
মৃগসম, মুহূর্ত্ত দাঁড়াতে নাহি পারে!
মহাকালী কালস্বরূপিণী, রয়েছেন
দাঁড়াইয়া তৃষাতীক্ষ্ন লোলজিহ্বা মেলি’,—
বিশ্বের চৌদিক বেয়ে চিররক্তধারা
ফেটে পড়িতেছে, নিষ্পেষিত দ্রাক্ষা হ’তে
রসের মতন অনন্ত খর্পরে তাঁর—
জয় । থাম, থাম, থাম! মায়াবিনি, পিশাচিনি,
মাতৃহীন এ সংসারে এসেছিস্ তুই
মা’র ছদ্মবেশ ধরে রক্তপান লোভে?
প্রেম মিথ্যা,
স্নেহ মিথ্যা, দয়া মিথ্যা, মিথ্যা আর সব,
সত্য শুধু অনাদি অনন্ত হিংসা! তবে
কেন মেঘ হ’তে ঝরে আশীর্ব্বাদ সম
বৃষ্টিধারা দগ্ধ ধরণীর বক্ষ পরে,
গলে’ আসে পাষাণ হইতে দয়াময়ী
স্রোতস্বিনী মরুমাঝে, কোটি কণ্টকের
শিরোভাগে কেন ফুল ওঠে বিকশিয়া?
ছলনা করেছ মোরে প্রভু! দেখিতেছ

**৩৩

মাতৃভক্তি রক্তসম হৃদয় টুটিয়া
ফেটে পড়ে কি না! আমারি হৃদয় বলি
দিলে মাতৃপদে। ওই দেখ হাসিতেছে
মা আমার স্নেহপরিহাসবশে! বটে,
তুই রাক্ষসী পাষাণী বটে, মা আমার
রক্ত-পিয়াসিনী! নিবি মা আমার রক্ত—
ঘুচাবি সন্তানজন্ম এ জন্মের তরে,
দিব ছুরি বুকে? এই শিরা-ছেঁড়া রক্ত
বড় কি লাগিবে ভালো? ওরে মা আমার
রাক্ষসী পাষাণী বটে! ডাকিছ কি মোরে
গুরুদেব? ছলনা বুঝেছি আমি তব!
ভক্তহিয়াবিদারিত এই রক্ত চাও!
দিয়াছিলে এই যে বেদনা, তারি পরে
জননীর স্নেহ-হস্ত পড়িয়াছে। দুঃখ
চেয়ে সুখ শতগুণ । কিন্তু রাজরক্ত!
ছি, ছি, ভক্তিপিপাসিতা মাতা তাঁরে বল
রক্তপিপাসিনী!
রঘু । বন্ধ হোক্ বলিদান
তবে!
জয় । হোক্ বন্ধ! না, না, গুরুদেব, তুমি
জান ভালোমন্দ! সরল ভক্তির বিধি
শাস্ত্রবিধি নহে। আপন আলোকে আঁখি
দেখিতে না পায়, আলোক আকাশ হ’তে
আসে। প্রভু, ক্ষমা কর— ক্ষমা কর দাসে!
ক্ষমা কর স্পর্দ্ধা মূঢ়তার! ক্ষমা কর
নিতান্ত বেদনাবশে উদ্‌ভ্রান্ত প্রলাপ?
বল প্রভু, সত্যই কি রাজরক্ত চান
মহাদেবী?
রঘু । হায় বত্স, হায়! অবশেষে
অবিশ্বাস মোর প্রতি?

**৩৪

জয় । অবিশ্বাস! কভু
নহে! তোমারে ছাড়িলে বিশ্বাস আমার
দাঁড়াবে কোথায়? বাসুকির শিরশ্চ্যুত
বসুধার মত, শূন্য হ’তে শূন্য পাবে
লোপ! রাজরক্ত চায় তবে মহামায়া,
সে রক্ত আনিব আমি। দিব না ঘটিতে
ভ্রাতৃহত্যা!
রঘু । দেবতার আজ্ঞা পাপ নহে।
জয় । পুণ্য তবে, আমিই সে করিব অর্জ্জন!
রঘু । সত্য করে’ বলি বত্স তবে। তোরে আমি
ভালবাসি প্রাণের অধিক— পালিয়াছি
শিশুকাল হতে তোরে মায়ের অধিক
স্নেহে, তোরে আমি নারিব হারাতে।
জয় । মোর
স্নেহে ঘটিতে দিব না পাপ, অভিশাপ
আনিব না এ স্নেহের পরে।
রঘু । ভালো ভালো
সে কথা হইবে পরে— কল্য হবে স্থির।
(উভয়ের প্রস্থান)
[\রঘুপতি ও জয়সিংহের প্রস্থান\]

**৩৫

{[\অপর্ণার প্রবেশ\]}
অপর্ণা । <(গান)
ওগো পুরবাসী।
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী।>
জয়সিংহ, কোথা জয়সিংহ! কেহ নাই
এ মন্দিরে! তুমি কে দাঁড়ায়ে আছ হেথা
অচল মূরতি— কোনো কথা না বলিয়া
হরিতেছ জগতের সারধন যত!
আমরা যাহার লাগি কাতর কাঙাল
ফিরে মরি পথে পথে সে আপনি এসে
তব পদতলে করে আত্মসমর্পণ!
তাহে তোর কোন্ প্রয়োজন! কেন তা’রে
কৃপণের ধন সম রেখে দিস্ পুঁতে
মন্দিরের তলে— <দরিদ্র এ সংসারের
সর্ব্ব ব্যবহার হ’তে করিয়া গোপন!>
জয়সিংহ, এ পাষাণী কোন্ সুখ দেয়,
কোন্ কথা বলে তোমা কাছে, কোন্ চিন্তা
করে তোমা তরে।— <প্রাণের গোপন পাত্রে
কোন সান্ত্বনার সুধা চির রাত্রি দিন
রেখে দেয় করিয়া সঞ্চিত!> ওরে চিত্ত
উপবাসী, কার রুদ্ধ দ্বারে আছ বসে’?

**৩৬

<গান
ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী।
হেরিতেছি সুখমেলা, ঘরে ঘরে কত খেলা,
শুনিতেছি সারাবেলা সুমধুর বাঁশি!>
রঘুপতির প্রবেশ
[\রঘুপতির প্রবেশ\]
রঘু । কে রে তুই এ মন্দিরে!
অপর্ণা । আমি ভিখারিণী।
জয়সিংহ কোথা!
রঘু । দূর হ এখান হ’তে
মায়াবিনী। জয়সিংহে চাহিস্ কাড়িতে
দেবীর নিকট হ’তে ওরে উপদেবী!
অপর্ণা । আমা হ’তে দেবীর কী ভয়? আমি ভয়
করি তা’রে, পাছে মোর সব করে গ্রাস!
(গাহিতে গাহিতে
<চাহি না অনেক ধন # রবনা অধিকক্ষণ,
যেথা হতে আসিয়াছি সেথা যাব ভাসি!
তোমরা আনন্দে র’বে # নব নব উত্সবে
কিছু ম্লান নাহি হবে # গৃহভরা হাসি!>
{[\অপর্ণার প্রস্থান\]}

±<তিমির দুয়ার খোলা>±

**৩৭

মন্দিরের সম্মুখ-পথ
{[\জয়সিংহের প্রবেশ\]}
জয়সিংহ
জয় । দূর হোক্ চিন্তাজাল! দ্বিধা দূর হোক্!
চিন্তার নরক চেয়ে কার্য্য ভালো, যত
ক্রূর, যতই কঠোর হোক্! কার্য্যের ত
শেষ আছে, চিন্তার সীমানা নাই কোথা;—
ধরে সে সহস্র মূর্ত্তি পলকে পলকে
বাষ্পের মতন,— চারিদিকে যতই সে
পথ খুঁজে মরে, পথ তত লুপ্ত হ’য়ে
যায়। এক ভালো অনেকের চেয়ে। তুমি
সত্য, গুরুদেব, তোমারি আদেশ সত্য—
সত্যপথ তোমারি ইঙ্গিতমুখে। হত্যা
পাপ নহে, ভ্রাতৃহত্যা পাপ নহে, নহে
পাপ রাজহত্যা!— সেই সত্য, সেই সত্য।
পাপ পুণ্য নাই, সেই সত্য। থাক্ চিন্তা,
থাক আত্মদাহ, থাক্ বিচার বিবেক।
কোথা যাও ভাইসব, মেলা আছে বুঝি
নিশিপুরে।— কুকী রমণীর নৃত্য হবে?
আমিও যেতেছি।— এ ধরায় কত সুখ
(গান)
বাউলের সুর
আমারে কে নিবি ভাই, সঁপিতে চাই আপনারে!
আমার এই মন গলিয়ে কাজ ভুলিয়ে সঙ্গে তোদের নিয়ে যারে।
দূরে অপর্ণার প্রবেশ
{[\অপর্ণার প্রবেশ\]}
ওকিও অপর্ণা! দূরে দাঁড়াইয়া কেন!
শুনিতেছ অবাক্ হইয়া, জয়সিংহ
গান গাহে? সব মিথ্যা, বৃহৎ বঞ্চনা,
তাই হাসিতেছি— তাই গাহিতেছি গান

**৩৮

ওই দেখ পথ দিয়ে তাই চলিতেছে
লোক নির্ভাবনা, তাই ছোট কথা নিয়ে
এতই কৌতুক হাসি, এত কুতূহল,
তাই এত যত্নভরে সেজেছে যুবতী।
সত্য যদি হ’ত, তবে হ’ত কি এমন?
সহজে আনন্দ এত বহিত কি হেথা?
তাহা হ’লে বেদনায় বিদীর্ণ ধরায়
বিশ্বব্যাপী ব্যাকুল ক্রন্দন থেমে গিয়ে,
মূক হ’য়ে রহিত অনন্তকাল ধরি।
বাঁশি যদি সত্যই কাঁদিত বেদনায়—
ফেটে গিয়ে সঙ্গিত নীরব হ’ত তা’র।
মিথ্যা বলে’ তাই এত হাসি; শ্মশানের
কোলে বসে খেলা, বেদনার পাশে শুয়ে
গান, হিংসা ব্যাঘ্রিণীর খর নখতলে
চলিতেছে প্রতিদিবসের কর্ম্মকাজ।
সত্য হ’লে এমন কি হত? হা অপর্ণা,
তুমি আমি কিছু সত্য নই— তাই জেনে
সুখী হও— বিষণ্ণ বিস্ময়ে মুগ্ধ আঁখি
তুলে কেন রয়েছিস্ চেয়ে। আয় সখি,
চিরদিন চলে’ যাই দুই জনে মিলে
সংসারের পর দিয়ে— শূন্য নভস্তলে
দুই লঘু মেঘখণ্ড সম!
রঘুপতির প্রবেশ
{[\রঘুপতির প্রবেশ\]}
রঘু । জয়সিংহ!
জয় । তোমারে চিনিনে আমি। আমি চলিয়াছি
আমার অদৃষ্টভরে ভেসে নিজ পথে
পথের সহস্র লোক যেমন চলেছে!
তুমি কে বলিছ মোরে দাঁড়াইতে? তুমি
চলে যাও— আমি চলে যাই!

**৩৯

রঘু । জয়সিংহ!
জয় । ওইত সম্মুখে পথ চলেছে সরল—
চলে যাব ভিক্ষাপাত্র হাতে, সঙ্গে লয়ে
ভিখারিণী সখী মোর।— কে বলিল এই
সংসারের রাজপথ দুরূহ জটিল!
যেমন করেই যাই, দিবা-অবসানে
পঁহুছিব জীবনের অন্তিম পলকে;
আচার বিচার তর্ক-বিতর্কের জাল
কোথা মিশে যাবে। ক্ষুদ্র এই পরিশ্রান্ত
নরজন্ম সমর্পিব ধরণীর কোলে;
দু’চারি দিনের এই সমষ্টি আমার,
দুচারিটা ভুল-ভ্রান্তি ভয় দুঃখ সুখ
ক্ষীণ হৃদয়ের আশা, দুর্ব্বলতা বশে
ভ্রষ্ট ভগ্ন এ জীবনভার, ফিরে দিয়ে
অনন্তকালের হাতে গভীর বিশ্রাম!
এইত সংসার! কি কাজ শাস্ত্রের বিধি,
কি কাজ গুরুতে!

—প্রভু, পিতা, গুরুদেব,
কি বলিতেছিনু! স্বপ্নে ছিনু এতক্ষণ!
এই সে মন্দির— ওই সেই মহাবট
দাঁড়ায়ে রয়েছে, অটল কঠিন দৃঢ়
নিষ্ঠুর সত্যের মত! কি আদেশ দেব!
ভুলি নাই কি করিতে হবে। এই দেখ,
(ছুরি দেখাই«+++»)
তোমার আদেশ স্মৃতি অন্তরে বাহিরে
হতেছে শাণিত। আরো কি আদেশ আছে
প্রভু!
রঘু । দূর ক’রে দাও ওই বালিকারে

**৪০

মন্দির হইতে। মায়াবিনী, জানি আমি
তোদের কুহক! দূর করে’ দাও ওরে!
জয় । দূর করে’ দিব? দরিদ্র আমারি মত
মন্দির আশ্রিত, আমারি মতন হায়
সঙ্গীহীন, অকণ্টক পুষ্পের মতন
নির্দ্দোষ, নিষ্পাপ, শুভ্র, সুন্দর, সরল
সুকোমল, বেদনাকাতর, দূর করে
দিতে হবে ওরে? তাই দিব গুরুদেব!
চলে যা’ অপর্ণা! দয়ামায়া স্নেহ প্রেম
সব মিছে! মরে যা’ অপর্ণা! সংসারের
বাহিরেতে কিছুই না থাকে যদি, আছে
তবু দয়াময় মৃত্যু! চলে যা’ অপর্ণা!
অপর্ণা । তুমি চলে এস জয়সিংহ এ মন্দির
ছেড়ে, দুইজনে চলে যাই!
জয় । দুইজনে
চলে যাই! এ তো স্বপ্ন নয়! একবার
স্বপ্নে মনে করেছিনু স্বপ্ন এ জগৎ!
তাই হেসেছিনু সুখে, গান গেয়েছিনু।
কিন্তু সত্য এ যে! বোলো না সুখের কথা
আর— দেখায়ো না স্বাধীনতা প্রলোভন—
বন্দী আমি সত্য কারাগারে!
রঘু । জয়সিংহ,
কাল নাই মিষ্ট আলাপের। দূর করে
দাও ওই বালিকারে!
জয় । চলে যা অপর্ণা!
অপর্ণা । কেন যাব?
জয় । এই নারী-অভিমান তোর?
অপর্ণা । অভিমান কিছু নাই আর। জয়সিংহ,
তোমার বেদনা, আমার সকল ব্যথা
সব গর্ব্ব চেয়ে বেশি। কিছু মোর নাই
অভিমান।

**৪১

জয় । তবে আমি যাই। মুখ তোর
দেখিব না, যতক্ষণ রহিবি হেথায়!
চলে যা অপর্ণা।
অপর্ণা । নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ, ধিক্
থাক্ ব্রাহ্মণত্বে তব! আমি ক্ষুদ্র নারী
অভিশাপ দিয়ে গেনু তোরে, এ বন্ধনে
জয়সিংহে পারিবি না বাঁধিয়া রাখিতে।
(প্রস্থা«+++»
{[\অপর্ণার প্রস্থান\]}
রঘু । বত্স, তোল মুখ, কথা কও একবার!
প্রাণপ্রিয় প্রাণাধিক, আমার কি প্রাণে
অগাধ সমুদ্রসম স্নেহ নাই! আরো
চাস্? আমি আজন্মের বন্ধু, দুদণ্ডের
মায়াপাশ ছিন্ন হয়ে যায় যদি, তাহে
এত ক্লেশ।
জয় । থাক্ প্রভু, বোলো না স্নেহের
কথা আর! কর্ত্তব্য রহিল শুধু মনে।
স্নেহপ্রেম তরুলতাপত্রপুষ্পসম
ধরণীর উপরেতে শুধু, আসে যায়
শুকায় মিলায় নব নব স্বপ্নবৎ!
নিম্নে থাকে শুষ্ক রূঢ় পাষাণের স্তূপ
রাত্রিদিন, অনন্ত হৃদয়ভারসম!
(প্রস্থান
{[\জয়সিংহের প্রস্থান\]}
রঘু । জয়সিংহ, কিছুতে পাইনে তোর মন,
এত যে সাধনা করি নানা ছলে বলে!
(প্রস্থান
{[\রঘুপতির প্রস্থান/]}

±{Drop
দিন ফুরালো হে সংসার
<তিমির দুয়ার খোলো>}±

**৪২

চতুর্থ দৃশ্য
মন্দিরপ্রাঙ্গণ
জনতা
{[\জনতার প্রবেশ\]}
গণেশ । এবারে মেলায় তেমন লোক হল না!
অক্রূর । এবারে আর লোক হবে কিরে? এ ত আর হিঁদুর রাজত্ব রইল না। এ যেন নবাবের রাজত্ব হয়ে উঠল! ঠাক্‌রুণের বলিই বন্ধ হয়ে গেল, ত মেলায় লোক আসবে কি!
কানু । ভাই, রাজার ত এ বুদ্ধি ছিল না, বোধ হয় কিসে তাকে পেয়েছে।
অক্রূর । যদি পেয়ে থাকে ত কোন মুসলমানের ভূতে পেয়েছে, নইলে বলি উঠিয়ে দেবে কেন?
গণেশ । কিন্তু যাই বল, এ রাজ্যের মঙ্গল হবে না।
কানু । পুরুত ঠাকুর ত স্বয়ং বলে দিয়েছেন তিন মাসের মধ্যে মড়কে দেশ উচ্ছন্ন যাবে।
হারু । ঐ রে রাজা আস্‌চে! সকালবেলাতেই আমাদের এ«+++» রাজার মুখ দেখলুম, দিন কেমন যাবে কে জানে! চল এখান থেকে সরে পড়ি!
(সকলের প্রস্থান)
{নয়নরায়} চাঁদপাল ও গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ
{[\<চাঁদপাল> {নয়নরায়} ও গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ\]}
<চাঁদ>{নয়নরায়} । মহারাজ, সাবধানে থেকো! চারিদিকে
চক্ষুকর্ণ পেতে আছি, রাজ-ইষ্টানিষ্ট
কিছু না এড়ায় মোর কাছে। মহারাজ,
তব প্রাণ-হত্যা তরে গুপ্ত আলোচনা
স্বকর্ণে শুনেছি।
গোবিন্দ । প্রাণহত্যা! কে করিবে?
চাঁদ । বলিতে সঙ্কোচ মানি। ভয় হয় পাছে
সত্যকার ছুরি চেয়ে নিষ্ঠুর সংবাদ
অধিক আঘাত করে রাজার হৃদয়ে!
গোবিন্দ । অসঙ্কোচে বলে যাও। রাজার হৃদয়

**৪৩

সতত প্রস্তুত থাকে আঘাত সহিতে।
কে করেছে হেন পরামর্শ?
চাঁদ । যুবরাজ
নক্ষত্র রায়।
গোবিন্দ । নক্ষত্র?
চাঁদ । স্বকর্ণে শুনেছি
মহারাজ, রঘুপতি যুবরাজে মিলে
গোপনে মন্দিরে বসে স্থির হয়ে গেছে
সব কথা।
গোবিন্দ । দুই দণ্ডে স্থির হয়ে গেল
আজন্মের বন্ধন টুটিতে! হায় বিধি!
চাঁদ । দেবতার কাছে তব রক্ত এনে দেবে—
গোবিন্দ । দেবতার কাছে! তবে আর নক্ষত্রের
নাই দোষ। জানিয়াছি, দেবতার নামে
মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ। ভয় নাই
যাও তুমি কাজে। সাবধানে রব আমি।
(চাঁদপালের প্রস্থান)
{[\চাঁদপালের প্রস্থান\]}
রক্ত নহে, ফুল আনিয়াছি, মহাদেবী,
ভক্তি শুধু, হিংসা নহে, বিভীষিকা নহে!
এ জগতে দুর্ব্বলেরা বড় অসহায়
মা জননি, বাহুবল বড়ই নিষ্ঠুর,
স্বার্থ বড় ক্রূর, লোভ বড় নিদারুণ,
অজ্ঞান একান্ত অন্ধ, গর্ব্ব চলে’ যায়
অকাতরে ক্ষুদ্রেরে দলিয়া পদতলে!
হেথা স্নেহ প্রেম অতি ক্ষীণবৃন্তে থাকে

**৪৪

পলকে খসিয়া পড়ে স্বার্থের পরশে।
তুমিও জননী যদি খড়্গ উঠাইলে,
মেলিলে রসনা, তবে সব অন্ধকার!
ভাই তাই ভাই নহে আর, পতি প্রতি
সতী বাম, বন্ধু শত্রু, শোনিতে পঙ্কিল
মানবের বাসগৃহ, হিংসা পুণ্য, দয়া
নির্ব্বাসিত। আর নহে, আর নহে, ছাড়
ছদ্মবেশ! এখনো কি হয়নি সময়?
এখনো কি রহিবে প্রলয় রূপ তব?
এই যে উঠিছে খড়্গ চারিদিক হতে
মোর শির লক্ষ্য করি, মাত একি তোরি
চারিভুজ হতে? তাই হবে! তবে তাই
হোক্।
জয়সিংহের প্রবেশ
{[\জয়সিংহের প্রবেশ\]}
জয় । বল্ চণ্ডি, সত্যই কি রাজরক্ত চাই?
এই বেলা বল্— বল্ নিজ মুখে, বল্
মানব ভাষায়, বল শীঘ্র, সত্যই কি
রাজরক্ত চাই?
নেপথ্যে । চাই!
জয় । তবে মহারাজ,
নাম লহ ইষ্ট দেবতার! কাল তব
নিকটে এসেছে!
গোবিন্দ । কি হয়েছে জয়সিংহ?
জয় । শুনিলে না নিজ কর্ণে? দেবীরে শুধানু,
সত্যই কি রাজরক্ত চাই— দেবী নিজে
কহিলেন— ‘চাই’!
গোবিন্দ । দেবী নহে জয়সিংহ,
কহিলেন রঘুপতি অন্তরাল হতে,
পরিচিত স্বর।

**৪৫

জয় । কহিলেন রঘুপতি?
অন্তরাল হতে? নহে নহে, আর নহে।
কেবলি সংশয় হতে সংশয়ের মাঝে
নামিতে পারিনে আর! যখনি কূলের
কাছে আসি— কে মোরে ঠেলিয়া দেয়
অতলের মাঝে! সে যে অবিশ্বাস দৈত্য।
আর নহে! গুরু হোক্, কিম্বা দেবী হোক্‌
একই কথা!
(ছুরিকা «+++»
ফুল নে মা! নে মা! ফুল নে মা
পায়ে ধরি, শুধু ফুল নিয়ে হোক্ তোর
পরিতোষ! আর রক্ত না মা, আর রক্ত
নয়! এও যে রক্তের মত রাঙা, দুটি
জবাফুল! পৃথিবীর মাতৃবক্ষ ফেটে
উঠিয়াছে ফুটে, সন্তানের রক্তপাতে
ব্যথিত ধরার স্নেহবেদনার মত।
নিতে হবে! এই নিতে হবে! আমি
নাহি ডরি তোর রোষ! রক্ত নাহি দিব!
রাঙা তোর আঁখি! তোল তোর খড়্গ! আন
তোর শ্মশানের দল! আমি নাহি ডরি!
(জয়সিংহ ব্যতীত সকলের প্রস্থান)
{[\গোবিন্দমাণিক্যের প্রস্থান\]}
এ কি হল হায়! দেবী গুরু যাহা ছিল
এক দণ্ডে বিসর্জ্জন দিনু— বিশ্ব মাঝে
কিছু রহিল না আর!

**৪৬

রঘুপতির প্রবেশ
রঘু । সকল শুনেছি
আমি। সব পণ্ড হল! কি করিলি, ওরে
অকৃতজ্ঞ?
জয় । দণ্ড দাও প্রভু!
রঘু । সব ভেঙ্গে
দিলি! ব্রহ্মশাপ ফিরাইলি অর্দ্ধপথ
হতে! লঙ্ঘিলি গুরুর বাক্য! ব্যর্থ করে’
দিলি দেবীর আদেশ! আপন বুদ্ধিরে
করিলি সকল হতে বড়! আজন্মের
স্নেহঋণ শুধিলি এমনি করে!
জয় । দণ্ড
দাও পিতা!
রঘু । কোন্ দণ্ড দিব?
জয় । প্রাণদণ্ড!
রঘু । নহে। তার চেয়ে গুরুদণ্ড চাই! স্পর্শ
কর্ দেবীর চরণ!
জয় । করিনু পরশ!
রঘু । বল্ তবে আমি এনে দিব রাজরক্ত
শ্রাবণের শেষ রাত্রে দেবীর চরণে!
জয় । আমি এনে দিব রাজরক্ত, শ্রাবণের
শেষ রাত্রে দেবীর চরণে।
রঘু । চলে যাও।

**৪৭

±{কোন্ ভীরুকে ভয় দেখাবি}±

প্রথম দৃশ্য
মন্দির
জনতা—রঘুপতি—জয়সিংহ
{[\রঘুপতি, জয়সিংহ ও জনতার প্রবেশ\]}
রঘু । তোরা এখানে সব কি কর্‌তে এলি?
সকলে । আমরা ঠাকরুণ দর্শন কর্ত্তে এসেছি।
রঘু । বটে! দর্শন কর্‌তে এসেছ? এখনো তোমাদের চোখ দুটো যে আছে সে কেবল বাপের পুণ্যে! ঠাকরুণ কোথায়? ঠাকরুণ এ রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন! তোরা ঠাকরুণকে রাখ্‌তে পারলি কৈ? তিনি চলে গেছেন।
সকলে । কি সর্ব্বনাশ! সে কি কথা ঠাকুর! আমরা কি করেছি!
রঘু । মা’র জন্যে এক ফোঁটা রক্ত দিতে পারিসনে এই ত তোদের ভক্তি?
অনেকে । রাজার আজ্ঞা, তা আমরা কি কর্‌ব!
রঘু । রাজা কে! মা’র সিংহাসন তবে কি রাজার সিংহাসনের নীচে? তবে এই মাতৃহীন দেশে তোদের রাজাকে নিয়েই থাক, দেখি তোদের রাজা কি করে’ রক্ষা করে!
(সকলের সভয়ে গুন্‌গুন স্বরে কথা)
অক্রূর । চুপ কর্! সন্তান যদি অপরাধ করে থাকে মা তাকে দণ্ড দিক্, কিন্তু একেবারে ছেড়ে চলে যাবে এ কি মা’র মত কাজ? বলে দাও, কি করলে মা ফির্‌বে!
রঘু । তোদের রাজা যখন রাজ্য ছেড়ে যাবে মাও তখন রাজ্যে ফিরে পদার্পণ করবে।
(নিস্তব্ধভাবে পরস্পরের মুখাবলোকন)
রঘু । তবে তোরা দেখ্‌বি? এইখানে আয়! অনেক দূর থেকে অনেক আশা করে ঠাক্‌রুণকে দেখতে এসেছিস, তবে একবার চেয়ে দেখ্।
(মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন। প্রতিমার পশ্চাদ্ভাগ দৃশ্যমান)
সকলে । ও কি! মা’র মুখ কোন দিকে?
অক্রূর । ওরে, মা বিমুখ হয়েছেন।
<সকলে । ওমা, ফিরে দাঁড়া মা! ফিরে দাঁড়া মা! ফিরে দাঁড়া>

**৪৮

±{ফিরিয়ে আন্‌ব তোকে}±

<মা! একবার ফিরে দাঁড়া! মা কোথায়! মা কোথায়! আমরা তোকে ফিরিয়ে আনব মা! আমরা তোকে ছাড়ব না!> চাইনে আমাদের রাজা! যাক্ রাজা! মরুক রাজা!
<জয় । (রঘুপতির নিকট আসিয়া) প্রভু, আমি কি একটি কথাও কব না!
রঘু । না!
জয় । সন্দেহের কি কোনো কারণ নেই!
রঘু । না!
জয় । সমস্তই কি বিশ্বাস করিব?
রঘু । হাঁ
অপর্ণা । (পার্শ্বে আসিয়া) জয়সিংহ, এস জয়সিংহ, শীঘ্র এস
এ মন্দির ছেড়ে!
জয় । বিদীর্ণ হইল বক্ষ!>
(রঘুপতি<, অপর্ণা, জয়সিংহের> প্রস্থান)
রাজার প্রবেশ
{[\গোবিন্দমাণিক্যের প্রবেশ\]}
প্রজাগণ । রক্ষা কর মহারাজ, আমাদের রক্ষা
কর— মাকে ফিরে দাও!
গোবিন্দ । বত্সগণ, কর
অবধান! সেই মোর প্রাণপণ সাধ
জননীরে ফিরে এনে দেব।
প্রজা । জয় হোক্
মহারাজ, জয় হোক্ তব!
গোবিন্দ । একবার
শুধাই তোদের, তোরা কি মায়ের গর্ভে
নিস্‌নি জনম? মাতৃগণ, তোমরা ত
অনুভব করিয়াছ কোমল হৃদয়ে
মাতৃস্নেহসুধা; বল দেখি মা কি নেই?
মাতৃস্নেহ সব হতে পবিত্র প্রাচীন;
সৃষ্টির প্রথম দণ্ডে মাতৃস্নেহ শুধু
একেলা জাগিয়া বসে ছিল, নতনেত্রে
তরুণ বিশ্বেরে কোলে ল’য়ে!

**৪৯

<তারি তরে সমস্ত হৃদয় দিয়ে!> আজ
কি এমন অপরাধ করিয়াছি মোরা
যার লাগি সে অসীম স্নেহ চলে গেল
চিরমাতৃহীন করে’ অনাথ সংসার!
বত্সগণ, মাতৃগণ, বল, খুলে বল,
কি এমনি করিয়াছি অপরাধ?
কেহ কেহ । মা’র
বলি নিষেধ করেছ! বন্ধ মা’র পূজা!
গোবিন্দ । নিষেধ করেছি বলি, সেই অভিমানে
বিমুখ হয়েছে মাতা, <আসিছে মড়ক,
উপবাস, অনাবৃষ্টি, অগ্নিরক্তপাত;
মা মোদের এমনি মা বটে!> দণ্ডে দণ্ডে
ক্ষীণ শিশুটিরে স্তন্য দিয়ে বাঁচাইয়ে
তোলে মাতা, সে কি তার রক্ত পান লোভে?
হেন মাতৃঅপমান মনে স্থান দিলি
যবে, আজন্মের মাতৃস্নেহস্মৃতিমাঝে
ব্যথা বাজিল না? মনে পড়িল না মা’র
মুখ?— রক্ত চাই, রক্ত চাই, গরজন
করিছে জননী, অবোলা দুর্ব্বল জীব
প্রাণভয়ে কাঁপে থরথর,— নৃত্য করে
দয়াহীন নরনারী রক্তমত্ততায়,
এই কি মায়ের পরিবার? পুত্রগণ,
এই কি মায়ের স্নেহছবি?
প্রজাগণ । মূর্খ মোরা
বুঝিতে পারিনে।

**৫০

গোবিন্দ । বুঝিতে পার না! শিশু
দুদিনের, কিছু যে বুঝে না আর, সেও
তার জননীরে বোঝে! সেও বোঝে ভয়
পেলে নির্ভয় মায়ের কাছে, সেও বোঝে
ক্ষুধা পেলে দুগ্ধ আছে মাতৃস্তনে, সেও
ব্যথা পেলে কাঁদে মা’র মুখ চেয়ে!— তোরা
এমনি কি ভুলে ভ্রান্ত হলি, মা’কে গেলি
ভুলে? বুঝিতে পার না মাতা দয়াময়ী?
বুঝিতে পার না জীবজননীর পূজা
জীবরক্ত দিয়ে নহে, ভালোবাসা দিয়ে!
বুঝিতে পার না— ভয় যেথা মা সেখানে
নয়, হিংসা যেথা মা সেখানে নাই, রক্ত
যেথা মা’র সেথা অশ্রুজল! ওরে বত্স,
কি করিয়া দেখাব তোদের, কি বেদনা
দেখেছি মায়ের মুখে, কি কাতর দয়া,
কি ভর্ৎসনা অভিমানভরা ছলছল
নেত্রে তাঁর! দেখাইতে পারিতাম যদি,
সেই দণ্ডে চিনিতিস্ আপনার মাকে!
«+++»জা । আপনি চাহিয়া দেখ,
বিমুখ হয়েছে মাতা সন্তানের পরে!
«+++»র্ণা । (মন্দিরের দ্বারে উঠিয়া)
বিমুখ হয়েছে মাতা! আয় ত মা, দেখি,
আয় ত সমুখে একবার।
(প্রতিমা ফিরাইয়া«+++»
এই দেখ
মুখ ফিরায়েছে মাতা!
{[\গোবিন্দমানিক্যের প্রস্থান\]}
«+++»লে । ফিরেছে জননী!
জয় হোক্ জয় হোক্!
<{জনতার প্রস্থান?}>
ভৈরবী— একতালা
থাক্‌তে আর ত পারলি নে মা, পারলি কৈ?
কোলের সন্তানেরে ছাড়্‌লি কৈ?

**৫১

±?±

দোষী আছি অনেক দোষে, ছিলি বসে ক্ষণিক রোষে
মুখ ত ফিরালি শেষে, অভয় চরণ কাড়্‌লি কৈ?
(সকলের প্রস্থান)
{[\জনতার প্রস্থান\]}
জয়সিংহ ও রঘুপতির প্রবেশ
{[\জয়সিংহ ও রঘুপতির পরবেশ\]}
জয় । সত্য বল, প্রভু, তোমারি এ কাজ।
রঘু । সত্য
কেন না বলিব? আমি কি ডরাই সত্য
বলিবারে? আমারি এ কাজ। প্রতিমার
মুখ ফিরায়ে দিয়েছি আমি। কি বলিতে
চাও, বল! হয়েছ গুরুর গুরু তুমি,
কি ভর্ৎসনা করিবে আমারে? দিবে কোন্
উপদেশ?
জয় । বলিবার কিছু নাই মোর!

±?±

±{Dark
<Drop
তিমির দুয়ার খোলা>}±

**৫২

±{তাতা ও হাসি}±

নক্ষত্রের প্রবেশ
{[\নক্ষত্ররায়ের প্রবেশ\]}
নক্ষত্র । (স্বগত) যেথা যাই সকলেই বলে “রাজা হবে?”
“রাজা হবে?” এ বড় আশ্চর্য্য কাণ্ড! একা
বসে থাকি তবু শুনি কে যেন বলিছে
রাজা হবে? রাজা হবে? দুই কানে যেন
বাসা করিয়াছে দুই টিয়ে পাখী— এক
বুলি জানে শুধু— রাজা হবে? রাজা হবে?
<ভালো বাপু তাই হ’ব— কিন্তু রাজরক্ত
সে কি তোরা এনে দিবি?
নক্ষত্রের প্রবেশ>
{[\গুণবতীর প্রবেশ\]}
নক্ষত্র, কোথায় যাও! ফিরে
যাও কেন? এত ভয় কা’রে তব? আমি
নারী, অস্ত্রহীন, বলহীন, নিরুপায়,
অসহায়,— আমি কি ভীষণ এত?
নক্ষত্র রায় । না, না,
মোরে ডাকিয়োনা!
গুণ । কেন কি হয়েছে?
নক্ষত্র । আমি
রাজা নাহি হ’ব।
গুণ । নাই হ’লে! তাই বলে
এত আস্ফালন কেন?
নক্ষত্র । চিরকাল বেঁচে
থাক্ রাজা, আমি যেন যুবরাজ থেকে
মরি।
গুণ । তাই মর! শীঘ্র মর। পূর্ণ হোক্

**৫৩

মনোরথ। আমি কি তোমার পায়ে ধরে
রেখেছি বাঁচিয়ে?
নক্ষত্র রায় । তবে কি বলিবে বল!
গুণ । যে চোর করিছে চুরি তোমারি মুকুট
তাহারে সরায়ে দাও! বুঝেছ কি?
<{+++?
তাতা ও হাসির প্রবেশ}>
নক্ষত্র । সব
বুঝিয়াছি, শুধু কে সে চোর বুঝি নাই!
<{তাতা হা«+++» প্রবেশ}>
গুণ । ওই যে বালক ধ্রুব। বাড়িছে রাজার
কোলে, দিনে দিনে উঁচু হ’য়ে উঠিতেছে
মুকুটের পানে।
নক্ষত্র । তাই বটে! এতক্ষণে
বুঝিলাম সব! মুকুট দেখেছি বটে
ধ্রুবের মাথায়! আমি বলি শুধু খেলা!
গুণ । মুকুট লইয়া খেলা? বড় কাল খেলা!
এই বেলা ভেঙে দাও খেলা— নহে তুমি
সে খেলার হইবে খেলনা!
নক্ষত্র । তাই বটে!
এ ত ভালো খেলা নয়!
গুণ । অর্দ্ধরাত্রে আজি
গোপনে লইয়া তা’রে দেবীর চরণে
মোর নামে কর নিবেদন। তার রক্তে
নিবে যাবে দেব রোষানল, স্থায়ী হ’বে
সিংহাসন এই রাজবংশে— পিতৃলোক
গাহিবেন কল্যাণ তোমার। বুঝেছ কি?
নক্ষত্র । বুঝিয়াছি।
গুণ । তবে যাও। যা বলিনু কর!
মনে রেখো, মোর নামে কোরো নিবেদন!
নক্ষত্র । তাই হবে। <মুকুট লইয়া খেলা!> এ কি
সর্ব্বনাশ! দেবীর সন্তোষ, রাজ্যরক্ষা,
পিতৃলোক— বুঝিতে কিছুই বাকি নেই।
{<গুণবতী ও নক্ষত্রের প্রস্থান>}

**৫৪

±আঁধার রাতে একলা±

চতুর্থ দৃশ্য
মন্দির সোপান
{রাত্রি}
{[\জয়সিংহের প্রবেশ\]}
জয়সিংহ
জয় । দেবি, আছ তুমি! দেবি, থাক তুমি,
এ অসীম রজনীর সর্ব্ব প্রান্তশেষে
যদি থাক কণামাত্র হয়ে, সেথা হ’তে
ক্ষীণতম স্বরে সারা দাও, বল মোরে
“বত্স আছি!”— নাই! নাই! দেবি নাই।
নাই? দয়া ক’রে থাক! অয়ি মায়াময়ী
মিথ্যা, দয়া কর্, দয়া কর্ জয়সিংহে,
সত্য হ’য়ে ওঠ্! আশৈশব ভক্তি মোর,
আজন্মের প্রেম তোরে প্রাণ দিতে নারে?
এত মিথ্যা তুই? এ জীবন কারে দিলি
জয়সিংহ! সব ফেলে দিলি সত্যশূন্য,
দয়াশূন্য, মাতৃশূন্য, সর্ব্বশূন্য মাঝে!
অপর্ণার প্রবেশ
{[\অপর্ণার প্রবেশ\]}
অপর্ণা, আবার এসেছিস? তাড়ালেম
মন্দির বাহিরে, তবু তুই অনুক্ষণ
আশেপাশে চারি দিকে ঘুরিয়া বেড়াস্
সুখের দুরাশা সম দরিদ্রের মনে?
সত্য আর মিথ্যায় প্রভেদ শুধু এই!
মিথ্যারে রাখিয়া দিই মন্দিরের মাঝে
বহুযত্নে, তবুও সে থেকেও থাকে না।

**৫৫

সত্যেরে তাড়ায়ে দিই মন্দির বাহিরে
অনাদরে, তবু সে ফিরে ফিরে আসে!
অপর্ণা, যাস্‌নে তুই, তোরে আমি আর
ফিরাব না আয়, এইখানে বসি দোঁহে!
অনেক হয়েছে রাত। ≮কৃষ্ণপক্ষশশী≯
উঠিতেছে তরু অন্তরালে। চরাচর
সুপ্তিমগ্ন, শুধু মোরা দোঁহে নিদ্রাহীন।
অপর্ণা, বিষাদময়ি, তোরেও কি গেছে
ফাঁকি দিয়ে মায়ার দেবতা? দেবতায়
কোন্ আবশ্যক! কেন তারে ডেকে আনি
আমাদের ছোট-খাট সুখের সংসারে?
তারা কি মোদের ব্যথা বুঝে? পাষাণের
মতো শুধু চেয়ে থাকে; আপন ভায়েরে
প্রেম হতে বঞ্চিত করিয়া, সেই প্রেম
দি তারে, সে কি তা’র কোন কাজে লাগে?
এ সুন্দরী সুখময়ী ধরণী হইতে
মুখ ফিরাইয়া তার দিকে চেয়ে থাকি,
সে কোথায় চায়? তার কাছে ক্ষুদ্র বটে
তুচ্ছ বটে, তবু ত আমার মাতৃধরা;
তার কাছে কীটবৎ তবু ত আমার
ভাই; অবহেলে অন্ধরথচক্রতলে
দলিয়া চলিয়া যায়, তবু সে দলিত
উপেক্ষিত, তারা ত আমার আপনার!
<আয় ভাই নির্ভয়ে দেবতাহীন হ’য়ে
আরো কাছাকাছি সবে বেঁধে বেঁধে থাকি।>
রক্ত চাই! স্বরগের ঐশ্বর্য্য ত্যজিয়া
এ দরিদ্র ধরাতলে তাই কি এসেছ?
সেথায় মানব নেই, জীব নেই কেহ,
রক্ত নেই, ব্যথা পাবে হেন কিছু নেই,
তাই স্বর্গে হয়েছে অরুচি! আসিয়াছ

**৫৬

মৃগয়া করিতে, নির্ভয় বিশ্বাসসুখে
যেথা বাসা বেঁধে আছে মানবের ক্ষুদ্র
পরিবার! অপর্ণা, বালিকা, দেবী নাই!
অপর্ণা । জয়সিংহ, তবে চলে এস, এ মন্দির
ছেড়ে!
জয় । যাব, যাব, তাই যাব, ছেড়ে চলে
যাব! হায় রে অপর্ণা, তাই যেতে হবে!
তবু যে রাজত্বে আজন্ম করেছি বাস
পরিশোধ করে দিয়ে তার রাজকর
তবে যেতে পাব! থাক ও সকল কথা!
দেখ্ চেয়ে, গোমতীর শীর্ণ জলরেখা
জ্যোত্স্নালোকে পুলকিত,— <কলধ্বনি তার
এক কথা শত বার করিছে প্রকাশ!
আকাশেতে অর্দ্ধচন্দ্র পাণ্ডুমুখচ্ছবি
শ্রান্তিক্ষীণ— বহু রাত্রিজাগরণে যেন
পড়েছে চাঁদের চোখে আধেক পল্লব
ঘুমভারে!> সুন্দর জগৎ! হা অপর্ণা,
এমন রাত্রির মাঝে দেবী নাই! থাক
দেবী! অপর্ণা, জানিস কিছু সুখভরা
সুধাভরা কোনো কথা? শুধু তাই বল!
যা শুনিলে মুহূর্ত্তে অতলে মগ্ন হ’য়ে
ভুলে যাব জীবনের তাপ, মরণ যে
কত মধুরতাময় আগে হ’তে পাব
তার স্বাদ!
অপর্ণা । হায় জয়সিংহ বলিতে পারিনে কিছু,
বুঝি মনে আছে কত কথা।
জয় । তবে আরো
কাছে আয়, মন হ’তে মনে যাক্ কথা!

**৫৭

—এ কি করিতেছি আমি অপর্ণা, অপর্ণা,
চলে যা মন্দির ছেড়ে, গুরুর আদেশ!
অপর্ণা । জয়সিংহ, হোয়োনা নিষ্ঠুর! বারবার
ফিরায়োনা! কি সহেছি অন্তর্যামী জানে!
জয় । তবে আমি যাই! এক দণ্ড হেথা নহে!
(কিয়দ্দূর গিয়া ফিরিয়া)
অপর্ণা, নিষ্ঠুর আমি? এই কি রহিবে
তোর মনে, জয়সিংহ নিষ্ঠুর কঠিন!
কখনো কি হাসিমুখে কহি নাই কথা?
কখনো কি ডাকি নাই কাছে? কখনো কি
ফেলি নাই অশ্রজল তোর অশ্রু দেখে?
অপর্ণা, সে সব কথা পড়িবে না মনে,
শুধু মনে রহিবে জাগিয়া, জয়সিংহ
নিষ্ঠুর পাষাণ? যেমন পাষাণ ওই
পাষাণের ছবি, দেবী বলিতাম যারে!
হায় দেবী, তুই যদি দেবী হইতিস্,
তুই যদি বুঝিতিস্ এই অন্তর্দাহ!
অপর্ণা । বুদ্ধিহীন ব্যথিত এ ক্ষুদ্র নারী হিয়া,
ক্ষমা কর এরে! এই বেলা এস,
জয়সিংহ, এস মোরা এ মন্দির ছেড়ে
যাই!
জয় । রক্ষা কর! অপর্ণা, করুণা কর!
দয়া ক’রে মোরে ফেলে চলে যাও! এক
কাজ বাকি আছে এ জীবনে, সেই হোক্
প্রাণেশ্বর, তার স্থান তুমি কাড়িয়ো না।
(দ্রুত প্রস্থান)
অপর্ণা । শত বার সহিয়াছি, আজ কেন আর
নাহি সহে। আজ কেন ভেঙে পড়ে প্রাণ!

±{Dusk
যাবার বেলায় পিছু ডাকে}±

**৫৮

পঞ্চম দৃশ্য
মন্দির
<{গভীর রাত্রি}>
নক্ষত্র রায়— রঘুপতি— নিদ্রিত ধ্রুব
{[\রঘুপতি, নক্ষত্র, ধ্রুব।\]
প্রবেশ}
রঘু । কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়সিংহ
এসেছিল মোর কোলে অমনি শৈশবে
পিতৃমাতৃহীন। সে দিন অমনি করে
কেঁদেছিল নূতন দেখিয়া চারিদিক,
হতাশ্বাস শ্রান্ত শোকে অমনি করিয়া
ঘুমায়ে পড়িয়াছিল সন্ধ্যা হ’য়ে গেলে
ওইখানে দেবীর চরণে! ওরে দেখে
তার সেই শিশু মুখ শিশুর ক্রন্দন
মনে পড়ে।
নক্ষত্র । ঠাকুর কোরো না দেরি আর,
ভয় হয় কখন সংবাদ পাবে রাজা!
রঘু । সংবাদ কেমন করে পাবে? চারিদিক
নিশীথের নিদ্রা দিয়ে ঘেরা!
নক্ষত্র । একবার
মনে হ’ল যেন দেখিলাম কার ছায়া!
রঘু । আপন ভয়ের!

**৫৯

নক্ষত্র । শুনিলাম যেন কার
ক্রন্দনের স্বর!
রঘু । আপনার হৃদয়ের!
দূর হোক্ নিরানন্দ! <এস পান করি
কারণ সলিল। (মদ্যপান) মনোভাব যতক্ষণ
মনে থাকে, ততক্ষণ দেখায় বৃহৎ,—
কার্য্যকালে ছোট হয়ে আসে! বহু বাষ্প
গলে’ গিয়ে এক বিন্দু জল! কিছুই না!
শুধু মুহূর্ত্তের কাজ! শুধু শীর্ণশিখা
প্রদীপ নিভাতে যতক্ষণ! ঘুম হ’তে
চকিতে মিলায়ে যাবে গাঢ়তর ঘুমে
ওই প্রাণ রেখাটুকু,— শ্রাবণ-নিশীথে
বিজুলী-ঝলক সম, শুধু বজ্র তা’র
চিরদিন বিঁধে রবে রাজদম্ভমাঝে!
এস, এস যুবরাজ, ম্লান হ’য়ে কেন
বসে আছ একপাশে— মুখে কথা নেই,
হাসি নেই, নির্ব্বাপিতপ্রায়। এস, পান
করি আনন্দ সলিল!>
নক্ষত্র । অনেক বিলম্ব
হ’য়ে গেছে। আমি বলি আজ থাক্! কাল
পূজা হ’বে।
রঘু । বিলম্ব হয়েছে বটে। রাত্রি
শেষ হ’য়ে আসে।
নক্ষত্ৰ । ওই শোন পদধ্বনি!
রঘু । কই! নাহি শুনি!
নক্ষত্র । ওই শোন! ওই দেখ
আলো!
<রঘু । সংবাদ পেয়েছে রাজা। আর তবে
এক পল দেরি নয়। জয় মহাকালী!
(খড়্গ উত্তোলন)>
রাজা ও প্রহরিগণের দ্রুত প্রবেশ
{[\গোবিন্দমাণিক্য ও অনুচরদিগের প্রবেশ\]}
<(রাজার নির্দেশক্রমে প্রহরীর দ্বারা রঘুপতি ও নক্ষত্র রায় ধৃত হইল)>

**৬০

±<{? অপর্ণার প্রবেশ ও ধ্রুবকে লইয়া প্রস্থান}>±

গোবিন্দ । (রঘুপতিকে) আর কিছু বলিবার আছে?
রঘু । কিছু নাই।
গোবিন্দ । অপরাধ করিছ স্বীকার?
রঘু । অপরাধ?
অপরাধ করিয়াছি বটে! দেবীপূজা
করিতে পারিনি শেষ,— মোহে মূঢ় হ’য়ে
বিলম্ব করেছি অকারণে! তার শাস্তি
দিতেছেন দেবী, তুমি উপলক্ষ শুধু!
গোবিন্দ । শুন সর্ব্বলোক, আমার নিয়ম এই—
পবিত্র পূজার ছলে দেবতার কাছে
যে মোহান্ধ দিবে জীববলি, কিংবা তারি
করিবে উদ্যোগ রাজ-আজ্ঞা তুচ্ছ করি,
নির্ব্বাসনদণ্ড তার প্রতি। রঘুপতি,
অষ্টবর্ষ নির্ব্বাসনে করিবে যাপন;
তোমারে আসিবে রেখে সৈন্য চারিজন
রাজ্যের বাহিরে!
রঘু । দেবী ছাড়া এ জগতে
এ জানু হয়নি নত আর কারো কাছে।
আমি বিপ্র তুমি শূদ্র, তবু জোড় করে
নতজানু আজ আমি প্রার্থনা করিব
তোমা কাছে, দুইদিন দাও অবসর
শ্রাবণের শেষ দুইদিন! তার পরে
শরতের প্রথম প্রত্যুষে— চলে যাব
তোমার এ অভিশপ্ত দগ্ধ রাজ্য ছেড়ে,
আর ফিরাবনা মুখ!
গোবিন্দ । দুই দিন দিনু
অবসর।
রঘু । মহারাজ রাজ অধিরাজ,
মহিমাসাগর তুমি কৃপা অবতার!
ধূলির অধম আমি, দীন অভাজন।
(প্রস্থান)

**৬১

গোবিন্দ । নক্ষত্র স্বীকার কর অপরাধ তব।
নক্ষত্র । মহারাজ, দোষী আমি! শত
দোষ ক্ষমা করিয়াছ নির্ব্বোধ ভ্রাতার,
আরবার ক্ষমা কর।
গোবিন্দ । নক্ষত্র, চরণ
ছেড়ে ওঠ! শোন কথা! ক্ষমা কি আমার
কাজ? বিচারক আপন শাসনে বদ্ধ,
বন্দী হ’তে বেশি বন্দী! এক অপরাধে
দণ্ড পাবে একজনে, মুক্তি পাবে আর
এমন ক্ষমতা নাই বিধাতার, আমি
কোথা আছি!
সকলে । ক্ষমা কর, ক্ষমা কর প্রভু!
নক্ষত্র তোমার ভাই!
গোবিন্দ । স্থির হও সবে।
ভাই বন্ধু কেহ নাই মোর, এ আসনে
যতক্ষণ আছি। প্রমাণ হইয়া গেছে
অপরাধ! ছাড়ায়ে ত্রিপুররাজ্যসীমা
ব্রহ্মপুত্র নদীতীরে আছে রাজগৃহ
তীর্থস্নানতরে, সেথায় নক্ষত্ররায়
অষ্টবর্ষ নির্ব্বাসন করিবে যাপন।
<(প্রহরিগণ নক্ষত্রকে লইয়া যাইতে উদ্যত। রাজার সিংহাসন হইতে অবরোহণ)>
গোবিন্দ । দিয়ে যাও বিদায়ের আলিঙ্গন! ভাই,
এ দণ্ড তোমার শুধু একেলার নহে,
এ দণ্ড আমার! আজ হ’তে রাজগৃহ
সূচিকণ্টকিত হয়ে বিঁধিবে আমায়!
রহিল তোমার সাথে আশীর্ব্বাদ মোর;
যত দিন দূরে র’বি রাখিবেন তোরে
দেবগণ!>
(নক্ষত্রের প্রস্থান)
±<নক্ষত্র>±
{[\সকলের প্রস্থান\]}

**৬২

মন্দিরপ্রাঙ্গণ
জয়সিংহ ও রঘুপতি
{Morn
[\জয়সিংহ ও রঘুপতি\]}
রঘু । গেছে গর্ব্ব, গেছে তেজ, গেছে ব্রাহ্মণত্ব!
ওরে বত্স, আমি তোর গুরু নহি আর!
কাল আমি অসংশয়ে করেছি আদেশ
গুরুর গৌরবে, আজ শুধু সানুনয়ে
ভিক্ষা মাগিবার মোর আছে অধিকার!
অন্তরেতে সে দীপ্তি নিভেছে, যার বলে
তুচ্ছ করিতাম আমি ঐশ্বর্য্যের জ্যোতি,
রাজার প্রতাপ। <নক্ষত্র পড়িলে খসি
তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মাটির প্রদীপ!
তাহারে খুঁজিয়া ফিরে পরিহাসভরে
খদ্যোৎ ধূলির মাঝে, খুঁজিয়া না পায়!
দীপ প্রতিদিন নেভে, প্রতিদিন জ্বলে,
বারেক নিবিলে তারা চিরঅন্ধকার!
আমি সেই চিরদীপ্তিহীন;> সামান্য এ
পরমায়ু, দেবতার অতি ক্ষুদ্র দান,
ভিক্ষা মেগে লইয়াছি তারি দুটো দিন
রাজদ্বারে নতজানু হ’য়ে! জয়সিংহ,
সেই দুই দিন যেন ব্যর্থ নাহি হয়!
সেই দুই দিন যেন আপন কলঙ্ক
ঘুচায়ে মরিয়া যায়! কালামুখ তার
রাজরক্তে রাঙা করে’ তবে যায় যেন!

**৬৩

বত্স, কেন নিরুত্তর! গুরুর আদেশ
নাহি আর। তবু তোরে করেছি পালন
আশৈশব, কিছু নহে তার অনুরোধ?
নহি কিরে আমি তোর পিতার অধিক
পিতৃবিহীনের পিতা বলে’? এই দুঃখ,
এত করে স্মরণ করাতে হ’ল! কৃপা-
ভিক্ষা সহ্য হয়, ভালোবাসা ভিক্ষা করে
যে অভাগ্য, ভিক্ষুকের অধম ভিক্ষুক
সে যে! বত্স, তবু নিরুত্তর? জানু তবে
আরবার নত হোক্! কোলে এসেছিল
যবে, ছিল এতটুকু, এ জানুর চেয়ে
ছোট, তার কাছে নত হোক্ জানু! পুত্র,
ভিক্ষা চাই আমি!
জয় । পিতা, এ বিদীর্ণ বুকে,
আর হানিয়োনা বজ্র! রাজরক্ত চাহে
দেবী, তাই তারে এনে দিব! যাহা চাহে
সব দিব! সব ঋণ শোধ করে দিয়ে
যাব! তাই হবে! তাই হবে!
(‍প্রস্থান«+++»
{[\জয়সিংহের প্রস্থান\]}
রঘু । তবে, তাই
হোক্! দেবী চাহে, তাই বলে দিস্! আমি
কেহ নই! হায় অকৃতজ্ঞ! দেবী তোর
কি করেছে? শিশু কাল হ’তে দেবী তোরে
প্রতিদিন করেছে পালন? রোগ হ’লে
করিয়াছে সেবা? ক্ষুধায় দিয়াছে অন্ন?
মিটায়েছে জ্ঞানের পিপাসা? অবশেষে
এই অকৃতজ্ঞতার ব্যথা নিয়েছে কি
দেবী বুক পেতে? হায়, কলিকাল! থাক্!
{[\রঘুপতির প্রস্থান\]
Drop}

**৬৪

±<{যে রাতে মোর দুয়ারগুলি}>±

প্রথম দৃশ্য
মন্দির বাহিরে ঝড়
পূজোপকরণ লইয়া রঘুপতি
{[\রঘুপতির প্রবেশ\]}
রঘু । এতদিনে আজ বুঝি জাগিয়াছ দেবি!
ওই রোষ হুহুংকার! অভিশাপ হাঁকি
নগরের ’পর দিয়া ধেয়ে চলিয়াছ
তিমিররূপিণি? ওই বুঝি তোর
প্রলয় সঙ্গিনীগণ দারুণ ক্ষুধায়
প্রাণপণে নাড়া দেয় বিশ্বমহাতরু!
আজ মিটাইব তোর দীর্ঘ উপবাস।
ভক্তেরে সংশয়ে ফেলি এত দিন ছিলি
কোথা দেবি? তোর খড়্গ তুই না তুলিলে
আমরা কি পারি? আজ কি আনন্দ, তোর
চণ্ডীমূর্ত্তি দেখে! সাহসে ভরেছে চিত্ত,
সংশয় গিয়েছে; হতমান নতশির
উঠেছে নূতন তেজে! ওই পদধ্বনি
শুনা যায়, ওই আসে তোর পূজা! জয়
মহাদেবী!

**৬৫

অপর্ণার প্রবেশ
{[\অপর্ণার প্রবেশ\]}
দূর হ’ দূর হ’ মায়াবিনী!
জয়সিংহে চাস তুই! আরে সর্ব্বনাশী
মহাপাতকিনী!
(অপর্ণার প্রস্থান)
{[\অপর্ণার প্রস্থান\]}
এ কি অকাল-ব্যাঘাত!
জয়সিংহ যদি নাই আসে! কভু নহে!
সত্যভঙ্গ কভু নাহি হ’বে তার!— জয়
মহাকালী, সিদ্ধিদাত্রী, জয় ভয়ংকরী!—
যদি বাধা পায়— যদি ধরা পড়ে শেষে—
যদি প্রাণ যায় তার প্রহরীর হাতে?
জয় মা অভয়া! জয় ভক্তের সহায়!
জয় মা জাগ্রত দেবী! জয় সর্ব্বজয়ী!
ভক্তবৎসলার যেন দুর্নাম না রটে
এ সংসারে! শত্রুপক্ষ নাহি হাসে যেন
নিঃশঙ্ক কৌতুকে! মাতৃঅহঙ্কার যদি
চূর্ণ হয় সন্তানের, মা বলিয়া তবে
কেহ ডাকিবেনা তোরে! ওই পদধ্বনি।
জয়সিংহ বটে। জয় নৃমুণ্ডমালিনী!
পাষণ্ডদলনী মহাশক্তি!
জয়সিংহের দ্রুত প্রবেশ
{[\জয়সিংহের প্রবেশ\]}
জয়সিংহ,—
রাজরক্ত কই?

**৬৬

জয় । আছে আছে! ছাড় মোরে!
নিজে আমি করি নিবেদন!— রাজরক্ত
চাই তোর, দয়াময়ী, জগত্পালিনী
মাতা? নহিলে কিছুতে তোর মিটিবে না
তৃষা? অমি রাজপুত, পূর্ব্ব পিতামহ
ছিল রাজা, এখনো রাজত্ব করে মোর
মাতামহবংশ— রাজরক্ত আছে দেহে!
এই রক্ত দিব! এই যেন শেষ রক্ত
হয় মাতা! এই রক্তে শেষ মিটে যেন
অনন্ত পিপাসা তোর, রক্ততৃষাতুরা!
(বক্ষে ছুরি বিন্ধন)
রঘু । জয়সিংহ! জয়সিংহ! নির্দ্দয়, নিষ্ঠুর!
এ কী সর্ব্বনাশ করিলিরে? জয়সিংহ
অকৃতজ্ঞ, গুরুদ্রোহী, পিতৃমর্ম্মঘাতী,
স্বেচ্ছাচারী? জয়সিংহ, কুলিশকঠিন!
ওরে জয়সিংহ, মোর একমাত্র প্রাণ,
প্রাণাধিক, জীবন-মন্থন-করা-ধন।
জয়সিংহ, বত্স মোর হে গুরুবত্সল!
ফিরে আয়, ফিরে আয়, তোরে ছাড়া আর
কিছু নাহি চাহি; অহঙ্কার অভিমান
দেবতা ব্রাহ্মণ সব যাক্! তুই আয়!
অপর্ণার প্রবেশ
{[\অপর্ণার প্রবেশ\]}
অপর্ণা । পাগল করিবে মোরে! জয়সিংহ, কোথা
জয়সিংহ!

**৬৭

রঘু । আয় মা অমৃতময়ি! ডাক্
তোর সুধাকণ্ঠে, ডাক ব্যগ্রস্বরে, ডাক্
প্রাণপণে! ডাক্ জয়সিংহে! তুই তারে
নিয়ে যা’ মা আপনার কাছে, আমি নাহি
চাহি!
(অপর্ণার মূর্ছা)
রঘু । (প্রতিমার পদতলে মাথা রাখিয়া)
ফিরে দে! ফিরে দে! ফিরে দে! ফিরে দে!

**৬৮

মন্দির
রঘুপতি
রঘু । দেখ, দেখ, কি করে দাঁড়ায়ে আছে, জড়
পাষাণের স্তূপ! মূঢ় নির্ব্বোধের মত!
মূক, পঙ্গু, অন্ধ ও বধির! তোরি কাছে
সমস্ত ব্যথিত বিশ্ব কাঁদিয়া মরিছে!
পাষাণ চরণে তোর, মহৎ হৃদয়
আপনারে ভাঙিছে আছাড়ি! হা হা হা হা!
কোন্ দানবের এই ক্রূর পরিহাস
জগতের মাঝখানে রয়েছে বসিয়া!
মা বলিয়া ডাকে যত জীব— হাসে তত
ঘোরতর অট্টহাস্যে নির্দ্দয় বিদ্রূপ!
দে ফিরায়ে জয়সিংহে মোর! দে ফিরায়ে!
দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী!
(নাড়া দিয়া)
শুনিতে কি
পাস্? আছে কর্ণ? জানিস্ কি করেছিস্?
কার রক্ত করেছিস্ পান? কোন্ পুণ্য
জীবনের? কোন্ স্নেহ দয়া প্রীতি ভরা
মহা হৃদয়ের?
থাক্ তুই চিরকাল
এই মত— এই মন্দিরের সিংহাসনে,
সরল ভক্তির প্রতি গুপ্ত উপহাস!
দিব তোর পূজা প্রতিদিন, পদতলে
করিব প্রণাম, দয়াময়ী মা বলিয়া
ডাকিব তোমারে! তোর পরিচয় কারো
কাছে নাহি প্রকাশিব, শুধু ফিরায়ে দে
মোর জয়সিংহে!— কার কাছে কাঁদিতেছি!
তবে দূর, দূর দূর, দূর করে’ দাও
হৃদয়-দলনী পাষাণীরে! লঘু হোক্
জগতের বক্ষ! (দূরে গোমতীর জলে নিক্ষেপ)

±<{জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি}>±

**৬৯

*গীতবিতান
*পূজা ৫৮৫

জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি হে,
নমি, নমি!
জয় জয় পরমা নির্ব্বিতি হে,
নমি, নমি।
নমি নমি তোমারে, হে অকস্মাৎ
গ্রন্থিচ্ছেদন খরসংঘাত,
সুপ্তি, লুপ্তি, বিস্মৃতি হে,
নমি, নমি!
অশ্রুশ্রাবণ প্লাবন হে নমি, নমি!
পাপক্ষালন পাবন হে, নমি নমি!
সব ভয় ভ্রম ভাবনার
চরমা আবৃতি হে, নমি নমি!!

**৭০

*বিসর্জন

<অপর্ণার প্রবেশ>
√ । এস পিতা, চল এ মন্দিরে ছেড়ে।
রঘুপতি । <আয় মা> পাষাণ ভাঙিয়া গেল, জননী আমার
এবার দিয়েছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা!
জননী অমৃতময়ী।!
অপর্ণা । পিতা চলে এস!
প্রস্থান

±ঝুনু
জয় জয় পরমা নিষ্কৃতি±

_end_

 

MANUSCRIPT SECTION

KeyFunction
HomeView first page
EndView last page
BackspaceView previous page
EnterView next page
Up ArrowScroll upward
Down ArrowScroll downward
Left ArrowScroll left
Right ArrowScroll right
+Zoom in
-Zoom out

TRANSCRIPTION SECTION

KeyFunction
Pg Upmove to top of page
Pg Dnmove to bottom of page
Ctl+increase font size of text
Ctl-decrease font size of text
Space Barhide/show (toggle) transcription panel

SIGNS USED IN MANUSCRIPT TRANSCRIPTION

SignNote/Explanation
<text>deleted text
{text}inserted text
+++illegible text
±text±text whose position is uncertain
৲text3৲ text2 text2 text2 text 2 text2 ৴text1৴text which has been transposed
[\text\]underlined text
⋋text of version1⋋ ⋌text of version2⋌two juxtaposed versions of the same text
≮text≯stet: retention of text earlier marked for deletion
[~  ] OR [~]If a note, comment, instruction etc. is placed in the margin, this marginalia is placed within square brackets [~  ]. The part of the main text against which it is located in the manuscript is indicated by the sign [~] at the beginning and end of that part.
<⋏⋏> OR {⋏text⋏} OR <⋎⋎> OR {⋎text⋎}Where the original author/scribe has changed the position of a small amount of text (a sentence or less) using an arrow, line or asterisk
  1. If a section is moved upward, this sign is placed at the original point (without the text)
    <⋏⋏>
  2. This sign is placed at the destination point, enclosing the text
    {⋏text⋏}
  3. If a section is moved downward, this sign is placed at the original point (without the text)
    <⋎⋎>
    This sign is placed at the destination point, enclosing the text
    {⋎text⋎}
  4. If there are multiple cases of migration in a page, they have been numbered as <⋏1⋏>, <⋏2⋏>, <⋏3⋏> according to their sequence in the page.
ORIf the position of a large amount of text has been changed, the following sign is placed at the destination point if the text has moved upward: ⋀ and the following if it has moved downward: ⋁
In these cases, no sign is placed at the original location.
A sign like ∟or a long vertical stroke in the original manuscript to indicate a line break or paragraph break has been recognized by moving the following section of the text to the next paragraph. The sign ∟ appears in the transcription at the start of this new paragraph.